“বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু”
সত্যি রবিঠাকুর এর লেখা এই কথা গুলো যে কতটা সত্যি তা আজ রাতটা আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। যদি সত্যিই কলকাতাকে ভালোবাসেন, যদি সত্যিই কলকাতার রূপে পাগল হতে চান তবে একটি বার রাতের কলকাতা দেখতে হয়।
শীতের কলকাতা, , , বসন্তের কলকাতা, শরতের কলকাতা, হেমন্তের কলকাতা, শুধু রাতটাকে দেখতে হয়। এখানে করোনা মহামারীর আগে এক কার্তিকের মানে হেমন্তের কলকাতা তুলে ধরা হচ্ছে। রাত্রি ১.১৫, গড়িয়াহাট চারমাথা পেরোনোর সময় একটা মাথাও চোখে পড়ল না, অথচ দিনের বেলায় বিরামহীন চলাচল। একটু এগিয়ে যেতেই ব্রীজের নিচে বেশ বড়সর একটা পথবাসি পরিবার বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
বালিগঞ্জ ফাঁড়ির পাঁচ মাথা পেরিয়ে সোজা পাচসর্কাস এর সাত মাথা। এখানে জনা দুই চলন্ত মানুষের দেখা হলো। যখন মা ব্রিজ ধরলাম তখন ঘড়িতে ১.২৩ , ভাবা যায় এত দ্রুত এই শহর!
গাড়ির স্পীড চল্লিশ তিরিশের একটু উপর, ভারী মিষ্টি লাগছে তোমাকে “হালকা সাদা কুয়াশার চাদরে ঢাকা সারা শরীর তোমার” ভিক্টোরিয়ার গায়ে কুয়াশ আলতো ভাবে জড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ থাম্বা গুলো কেমন লাজুক ভাবে তার দ্যুতি দিচ্ছে। কলকাতার রাস্তা ঘাট গুলো যেনো তার শরীরের শিরা উপ শিরা, কেমন নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে আছে যেনো। রেস কোর্স টা যেনো তখনও তার কলকাতার রয়্যাল টার্ফ ক্লাব নাম টাকেই ধরে রেখেছে। মানে ব্রিটিশ আমলের গন্ধ টা যেনো এই রাত্রে পাওয়া যায়।
রেস কোর্স কে বা দিকে রেখে হসপিটাল রোড ধরে এগোচ্ছি আর ডান দিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল টা হালকা চাঁদের আলো আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আরো স্বপ্নালু লাগছে। সোজা ক্যাসুরিনা রোড না ধরে ভিক্টোরিয়া কে একটু জড়িয়ে ধরতে কুইন্স ওয়ে ধরে এগিয়ে গেলাম, ভিক্টোরিয়ার গেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওই রূপসী স্মৃতিসৌধ টাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেছিলাম আর ভাবছিলাম এই স্মৃতিসৌধ আমার জন্মের চল্লিশ বছর আগে এই কলকাতায় জন্মেছে, ১৯২১ সালে এই ইতালীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যটি নির্মিত হয়। সাদা পাথরের এই স্মৃতিসৌধ। এখনও বয়সে আমার থেকে ছোটই মনে হচ্ছে।
এলিয়ট পার্ক টপকে পার্ক স্ট্রিট পৌঁছে একটু এই সাহেব পারাটাকে সন্ধানী চোখে দেখছিলাম কোনো রাতের ঘটনার সাক্ষী হবার আশায়,ঘড়ি কাঁটা তখন ২.৩০ এর ঘরে দাঁড়িয়ে। এই চৌরঙ্গী এলাকাটা রাত্রে এক রহস্য পুরী যেনো। ধীরে ধীরে স্বায়ত গাড়িটা ধর্মতলার দিকে এগিয়ে নিচ্ছে আর আমি ক্যামেরা হাতে কোনো বিষয় খুঁজে চলেছি।
গ্র্যান্ড হোটেল, বেশ কিছু ঘরের হলুদ বাতি গুলো যেনো এক অলস রাত্রের ছবি তুলে ধরছে। আরো একটু এগিয়ে মেট্রোপলিটন বিল্ডিং এর নিচে গাড়ি দাঁড় করাতে বললাম। এই সেই ধর্মতলা বা এস্প্লানেড। দিনের বেলায় সব ধর্ম একাকার, রাত্রে যে যার ডেরায় ফিরে নিজ নিজ ধর্ম ধারণ করেন। এটা সাহেব পারা নামে পরিচিত, টিপু সুলতান মসজিদ, জানবাজারে বৌদ্ধদের বসতি । জায়গাটার নাম ধর্মতলা, যা আবার এসপ্ল্যানেড নামেও পরিচিত।
জানবাজার এলাকায় বৌদ্ধদের একটা বসতি ছিল। তারা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেন।
আবার গ্রামবাংলার উপাস্য দেবতা ধর্মঠাকুরের মন্দির ছিল। একটা সিঁদুর মাখানো বড়ো পাথরের টুকরো ছিল তাতে বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, ডোম সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো করতো। তাই এখানে হিন্দু, মুসলমান ও ক্রিশ্চান মানুষজন একসাথে অবস্থান করতো ও এখনও করছে। সেখান থেকেই ধর্মতলা নামটা এসেছে হয়তো !
অঞ্চল জুড়ে শুধু সুনসান ভাব দু একটা রাত জাগা কুকুর আর মাঝে আছে দু একটা গাড়ির ছোটাছুটি এই হচ্ছে রাত্রি তিনটে তে ধর্মতলা।
মেট্রোপলিটান বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে এই কলকাতার সব থেকে বড়ো বাড়ি গুলির একটিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিলাম। এটি সাহেব আমলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। নিও-ব্যারোক স্থাপত্যশৈলীর একটি নিদর্শন এটি। ১৯০৫ সালে এই ভবনটি নির্মিত হয়। এখনও দীর্ঘ আয়ু এর শরীরে বিদ্যমান। একটা কেমন যেনো শব্দ এর পাঁজর থেকে বেরিয়ে আসছে। কান পাতলে ভারী বুটের আওয়াজ। গাড়ি ঘুরিয়ে এবার চললাম ডালহৌসি লাল দীঘি লাল বাড়ি, আর পুরনো রেডিও স্টেশন এর দিকে। ওদিকে ঘড়িতে চোখ, যাতে আজ অন্তত ন্যাশনাল লাইব্রেরী টা দেখা হয়। শুনেছি ওখানে এখনও সেই পুলিশ অফিসার টিকে নাকি দেখা যায়।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-06-09 19:49:13
Source link
Leave a Reply