‘আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।’ এটি ছিল জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞাপনচিত্রের সংলাপ। একসময় এটি সবার মুখে মুখে শোনা গেছে। বিজ্ঞাপনে ছেলেটির এই প্রস্তাবে মেয়েটি বলে, ‘না, আরেক দিন।’ এ কথা শুনে ছেলেটি ফিরে যায়। অপেক্ষা করে আরেক দিনের জন্য।
কিন্তু বাস্তবে যে ছেলেটি মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিল, সে নাছোড়বান্দা। তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই ছাড়বে। তাঁকে মোটরসাইকেলে উঠতে বলে। অচেনা যুবকের মোটরসাইকেলে কিছুতেই উঠতে চাননি তিনি। হয়তো ভেবেছিলেন, এ ছেলেটিও বিজ্ঞাপনচিত্রের ছেলেটির মতো চলে যাবে। কিন্তু ওই বখাটে যুবক মেয়েটিকে জোর করে মোটরসাইকেলে তুলতে যায়। মেয়েটি দৌড় দিতে চেষ্টা করেন, এমন সময় ওই মোটরসাইকেল দিয়ে নির্মমভাবে ধাক্কা দিয়ে মেয়েটিকে চলন্ত বাসের নিচে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনাচক্রে বাসের চাকার নিচে চাপা না পড়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে এসে আবার মোটরসাইকেলের ওপর পড়েন মেয়েটি। এতে মেয়েটির কলার বোন এবং বুকের চারটি হাড় ছয় জায়গায় ভেঙে যায়। প্রায় দুই মাস ধরে তিনি শয্যাশায়ী।
মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। বাড়ি নওগাঁর আত্রাই উপজেলার বড়ভিটা গ্রামে। পড়াশোনা শেষ হয়নি। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষার্থী। গত ২২ এপ্রিল তাঁর বিয়ে হয়েছে। স্বামীর বাড়ি রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায়। গত ৩ সেপ্টেম্বর ঈদের বাজার করার জন্য রাজশাহী শহরে যাবেন।
এ জন্য মোহনপুর উপজেলার সদরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে তিন যুবক এসে দাঁড়ায় তাঁর পাশে। পেছন থেকে দুই যুবক নেমে দাঁড়ায়। একজন মোটরসাইকেল নিয়ে এসে মেয়েটির কাছে জানতে চায়, কোথায় যাবেন। রত্না রাজশাহীতে যাওয়ার কথা বললে সে বলে, ‘চলেন, আমার মোটরসাইকেলে আপনাকে পৌঁছে দিই।’ মেয়েটি বাসে যাওয়ার কথা বললে যুবক তাঁকে তার মোটরসাইকেলে নেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। তার হাত থেকে বাঁচতে মেয়েটি দৌড় দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময়ই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
হাসপাতাল থেকে কিছুদিন চিকিত্সা নেওয়ার পর মেয়েটিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সারা দিন তাঁকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। নিজে নিজে শুতেও পারেন না, উঠতেও পারেন না। ধরে উঠাতে হয়, ধরেই শুইয়ে দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে একবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের চিকিত্সককে দেখাতে হয়।
মেয়েটির স্বামী জানান, ঘটনার পর তিন যুবক মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। পরে জানা গেছে, এই ঘটানার নায়ক হাবিবুর রহমান একজন মাদক ব্যবসায়ী। তিনিই মোটরসাইকেলের ওপর বসে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তাঁর সহযোগী মোটরসাইকেল আরোহী মাসুদও মাদক ব্যবসায়ী। অপর সহযোগী আবু সাইদ মোহনপুর থানার সামনে অবৈধ যানবাহন ‘ভটভটি’ থেকে চাঁদা ওঠান।
স্বামী জানান, খোঁজখবর নিয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর থানায় একটি মামলা করেছেন। বর্তমানে মামলার সব আসামিই জামিনে রয়েছেন।
মোহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামও স্বীকার করেছেন, হাবিবুরের প্রতিবেদন খুব খারাপ। তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল।
মেয়েটির বাবা বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়ে। শখ করে বিয়ে দিয়েছিলাম। বিয়ের আমেজ না কাটতেই মেয়েটাকে এ অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে হচ্ছে। খুব খারাপ লাগে।’
এরই মধ্যেস্নাতক (সম্মান) পরীক্ষা হয়েগেছে, কিন্তু মেয়েটি পরীক্ষা দিতে পারেননি।মেয়েটির কষ্ট চোখেদেখা যায়না। সমাজের বখাটেদের অত্যাচারে এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট পায় মেয়েরা।
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৩, ২০০৯
Leave a Reply