হাইলাইটস
- করোনা (Corona) আবহে মানুষের জীবন বদলে যাচ্ছে রাতারাতি, পাল্টে যাচ্ছে সম্পর্কের মানে।
- রোগ হলে কী হবে কেউ জানে না। ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানে না।
- অতিমারির হাত ধরে বাড়ছে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকীত্ব, বাড়ছে অবসাদ। ঘরের মানুষদের সঙ্গেও বাড়ছে দূরত্ব।
- চেনা দুনিয়া পাল্টে গিয়েছে ক-দিনেই। গ্রাস করেছে অস্তিত্বের সংকট।
করোনা অতিমারির (Coronavirus) হাত ধরে যে হারে মানসিক চাপ (Depression), উদ্বেগ, একাকীত্ব, অবসাদ বাড়ছে। গৃহবন্দি অবস্থায় আতঙ্কের সঙ্গে যুঝতে কী করতে হবে? বাড়ির শিশুদের কেমন রাখবেন? পরামর্শ দিচ্ছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ তণয়া রায়চৌধুরী। এই সময় ডিজিটালের তরফে সাক্ষাৎকার নিলেন শ্রাবণী অধিকারী।
এই সময় ডিজিটাল: করোনা অতিমারির হাত ধরে যে হারে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, একাকীত্ব, অবসাদ বাড়ছে, তাতে কী বলা যায় করোনা মনোরোগের মহামারি?
তণয়া রায়চৌধুরী: প্রথমে এই বিষয়ে কথা বলার জন্য ধন্যবাদ জানাই আপনাদের। এটা দু’রকমভাবে আমরা ভাবতে পারি। যদি প্রশ্নের সমর্থনে বলতে চাই, তাহলে কয়েক বছর পিছিয়ে গিয়ে শুরু করা উচিত। WHO কয়েক বছর আগে ঘোষণা করেছিল, যে ২০৩০ সালের মধ্যে অবসাদ প্রথম স্থান পাবে global burden of disease-এর তালিকায়। এ ক্ষেত্রে কোভিড এই প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে গেল বলাই যায়। আর এটাকে যদি ইতিবাচক দিক দিয়ে ভাবা যায়, তাহলে বলা যেতে পারে, আমরা যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি এটা সম্পর্কে আমাদের কোনও আগাম প্রস্তুতি বা ধারণা ছিল না। আমরা প্রত্যেকে মানসিক উদ্বেগ, শোক -এই সবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এই সবটাকে মানসিক বা মনের রোগ (Mental Disorders or Mental Illness) বলতে পারি না। যখন এই শোক, উদ্বেগ আমাদের রোজকার জীবনযাপনকে ব্যাহত করবে, তখন তাকে মনোরোগ বলা যাবে। কাজেই করোনাকালকে মনোরোগের মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়ে একমত নই।
এই সময় ডিজিটাল: গৃহবন্দি অবস্থায় আতঙ্কের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে মনের সব প্রতিরোধ ভেঙে গেলে, বিশেষ করে যাঁরা উদ্বেগপ্রবণ বা অন্য মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, কী হবে তাঁদের অবস্থা?
তণয়া রায়চৌধুরী: যাঁরা অসুস্থ রয়েছেন তাঁরা তাঁদের চিকিৎসা বন্ধ রাখবেন না, আর যাঁরা এই পরিস্থিতিতে সমস্যায় পড়ে যাচ্ছেন, তাঁরা কোনও বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে পরামর্শ নিন। অনলাইনে এখন বিশেষজ্ঞরা সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের কাছ থেকে চিকিৎসা শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ।
এই সময় ডিজিটাল: আক্রান্ত ও মৃতের ক্রমবর্ধমান গ্রাফ দেখে হতাশা গ্রাস করেছে। গ্রাস করেছে অবসাদ। অবসাদ কমানোর ওষুধ না অন্য কিছু?
তণয়া রায়চৌধুরী: এখন মৃত্যু মানে পুরোটাই ভয়। সংবাদপত্র, সোশ্যালমিডিয়া, TV – সবেতেই মৃত্যুর খবর। যেটা কিনা আমাদের ভীষণ সমস্যায় ফেলছে। তবে, আমরা যদি গ্রাফটা দেখি মৃত্যু যেমন হচ্ছে, তেমন ততটাই মানুষ সুস্থও হচ্ছেন। কিন্তু, আমরা ওই নেতিবাচক দিকটাই বেশি করে নিচ্ছি। যার ফলে আমরা অবসাদের শিকার হচ্ছি। অবসাদ কমানোর ওষুধ অনেক কিছুই আছে। আমি বলব, যাঁদের খুব বেশি করে সমস্যা হচ্ছে না তাঁদের জন্য খবরের ধরনটা একটু পালটাতে হবে। নেতিবাচক খবরের বদলে একটু ইতিবাচক খবর জেনে রাখা দরকার। যেমন, আমাদের কিছু প্রয়োজন হলে কার কাছে আগে যেতে হবে এই সব খবর জেনে রাখা দরকার।
এখন যেহেতু আমরা সকলে ঘরে রয়েছি, সবাই মিলে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত। আগে আমরা পরিবারের জন্য সেভাবে সময় পেতাম না, এখন যেহেতু সেই সময়টা পাচ্ছি, সকলের সঙ্গে আনন্দে কাটানোই ভালো। বাচ্চাদের একটু সময় দেওয়া যেতে পারে, আমাদের পুরনো যে হবি ছিল, সেগুলো আরও একবার ঘষে-মেজে নেওয়া যেতে পারে। সাবধানে থেকে একটু নিজেদের মধ্যে সময় বের করে নেওয়া। বন্ধুদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটের মাধ্যমে আড্ডা দেওয়া, আমাদের রোজের যা কাজ তা সঠিক সময়ে সম্পূর্ণ করলে, আমরা অনেক বেশি ভালো থাকতে পারব। যদিও এই সময়টা ভালো থাকার সময় নয়, তবুও যদি একটু চেষ্টা করা যায়।
এই সময় ডিজিটাল: বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতি হওয়ার কতটা আশঙ্কা রয়েছে?
তণয়া রায়চৌধুরী: এঁরা সামনের সারিতে থেকে কাজ করছেন বলে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। আসলে মনের সমস্যা তো আর মাপা যায় না। কোন মানুষ কোন ঘটনাকে কেমনভাবে নেবে তা প্রতিটা মানুষের কাছে আলাদা আলাদা ভাবে ঘটে থাকে। কাজেই আমরা এটা বলতে পারি না যে ওঁরা সামনে থেকে এত মৃত্যু দেখছেন, হতাশার খবর পাচ্ছেন, ফলে তাঁদের মানসিক সমস্যা দেখা দেবে। তবে, এই পরিস্থিতিতে নিজেদের জন্য কোনও সময় নেই স্বাস্থ্যকর্মীদের। এক্ষেত্রে আমায় তাঁদের একটু বলার আছে, নিজেদের প্রয়োজনটুকু যদি একটু মিটিয়ে নেন। খাওয়া, ঘুম যেন ঠিক করে মেনে চলেন তাহলে তাঁদের ঝুঁকিটা একটু কম হয়।
এই সময় ডিজিটাল: করোনায় আক্রান্ত হলে মানসিকস্বাস্থ্য কী ভাবে বিঘ্নিত হয়?
তণয়া রায়চৌধুরী: কেউ সংক্রামিত বলে, মানসিকস্বাস্থ্য যে বিঘ্নিত হবে তা কিন্তু নয়। তবে, অনেকেই আছেন যাঁরা হাসপাতাল থেকে ফিরে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। কারণ, হাসপাতালে চোখের সামনে হয়তো মৃত্যু দেখেছেন। আবার অনেকেই আছেন সেরে ওঠার পর বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। যাকে আমরা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বলে থাকি। অনেকে আবার রাতে ঘুমাতে পারছেন না, দুঃস্বপ্ন দেখছেন। কারোর ক্ষেত্রে শুধুই আতঙ্ক কাজ করছে। যাঁরা দূরে আছেন বাবা-মা এখানে রয়েছেন তাঁদের ক্ষেত্রে এই সমস্য তৈরি হচ্ছে। এমনও কিছু মানুষের থেকে শুনছি, হয়তো শেষ দেখাটাও হবে না। এটা সত্যিই বেদনাদায়ক। আমি এর পরিসংখ্যানটা সত্যিই বলতে পারব না যে কত মানুষের মধ্যে এই ঝুঁকিটা রয়েছে। করোনা হলেই যে মানসিক সমস্যা হবে, তা কিন্তু নয়। তবে, আমরা বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখতে পাচ্ছি।
এই সময় ডিজিটাল: কোয়ারানটাইন থাকার সময়ে কী ভাবে মানসিক বিপর্যয় এড়িয়ে চলতে হবে?
তণয়া রায়চৌধুরী: ভালো থাকতে হলে কী করতে হবে তা আগে বলেছি। তবে, এটা বলতে চাই আমাদের কাছে যতটুকু আছে তা নিয়েই খুশি থাকতে চাই। যাকে Sense of Containment বলা হয়। অনেকেই বলবেন হয়তো, এই পরিস্থিতিতে এটা বলাটা খুব সহজ করাটা খুব জটিল। তবুও এটা বলব এটা মেনে চললে ভালো। যেমন এখন আমাদের অনেককেই ভাবতেও হচ্ছে না রাতের খাবারটা কীভাবে আসবে, বা আর দু’দিন পর আমার চালটা কেমন করে জোটাতে পারব। আমাদের যেটুকু আছে, সেটা নিয়েই যদি ভালো থাকি তাহলে, এই কঠিন পরিস্থিতি পেরিয়ে গেলেও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকতে সাহায্য করবে।
এই সময় ডিজিটাল: Work From Home-এ কাজের ফলে বেশিরভাগের মধ্যেই একাধিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় সমস্যা ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স করা, এ ক্ষেত্রে চাপ কমানো যাবে কী ভাবে?
তণয়া রায়চৌধুরী: Work From Home যেহেতু গত বছর থেকে চলছে, সেক্ষেত্রে এটা বলতে পারি না এটা করবেন না, বা ওটা করবেন না। ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স করতে আপনাকে নিজেকেই করতে হবে। বাড়িতে আছি বলে পুরোটাই বাড়িকে দেব, তেমনটা কিন্তু নয়। বাড়ি এবং অফিস দুইই সামলাতে হবে আপনাকে।
প্রথমেই মনে করতে হবে, আপনি বাড়িতে থাকলেও অফিসেরই কাজ করছেন। এটা মেনে নিলে সমস্যাটা কম হয়। তবে, যদি দু’জনেই বাড়ি থেকে কাজ করেন এবং বাড়িতে বয়স্ক বা শিশুরা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমি বলব, শিফট চেঞ্জ করে নেওয়া। যার যেটা সুবিধা হবে সে সেই শিফটে কাজ করবেন। যদি সেক্ষেত্রে সুযোগ না থাকে তাহলে, আগের রুটিনে ফিরে যাওয়া ভালো। বাড়িতে সব কাজ সামলে, সবার মাঝে অফিস করা বা অফিসের কাজে মনোনিবেশ করা। বাড়িতে যদি পরিস্থিতি থাকে তাহলে কাজের জন্য আলাদা জায়গা তৈরি করলে ভালো। কাজের সময় সেখানেই বসে কাজ করলে অফিসের মতো অনুভূতি হতে পারে। পাশাপাশি অন্যমনস্ক হওয়ার সম্ভাবনাও কমে।
এই সময় ডিজিটাল: করোনাকালে লকডাউনের কারণে শিশুদের বাইরে বেরনো বন্ধ। তাদের মানসিক অবস্থা কীরকম প্রভাবিত হচ্ছে? এক্ষেত্রে বাবা মা-র জন্য কী করণীয়?
তণয়া রায়চৌধুরী: শিশুরা ঘরে বসে বসে একঘেয়ে হয়ে পড়েছে। ফলে দুষ্টুমি বেড়ে গিয়েছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়েছে। শিশুদের ছেলেবেলায় যা পাওয়ার কথা ছিল তা আমরা কোনও ভাবেই ফিরিয়ে দিতে পারব না। এক জন ৩-৫ বছরেরে শিশুদের মধ্যে কিন্তু মৃত্যু সম্পর্কে একটা অস্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ও তার সংখ্যা নিয়ে ওদের সামনে বেশি আলোচনা না করাই বাঞ্ছনীয়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে তা হয় না। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অনেকেই প্রিয়জনকে হারিয়েছে, সে ক্ষেত্রে মৃত্যু তাদের কাছে পরিস্কার নয়। এক্ষেত্রে তাদের কাছে খোলামেলা আলোচনা করা ভালো। ওদের মতো করে ওরা বুঝে নিতে পারবে।
আর একটা জিনিস বলা যেতে পারে, কোনও ভাবে দাম্পত্য কলহ হলেও খেয়াল রাখতে হবে, বাবা-মার মধ্যেকার অশান্তি যেন সন্তানকে কোনও ভাবে প্রভাবিত না করে ফেলে। চেষ্টা করুন, নিজেদের মধ্যেও কোনও অশান্তি হলে তা দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে। এতে এই সময় মনের উপর উল্টো প্রভাব পড়বে ও শিশুর মধ্যে হতাশা তৈরি হবে।
এই সময় ডিজিটাল: আমার শেষ প্রশ্ন,সুস্থ থাকতে বা ভালো থাকতে আমরা কী করব?
কোভিড বিধি মেনে চলা, সঠিক পদ্ধতিতে মাস্ক পরা, সামাজির দুরত্ব মেনে চলা। আর মানসিক ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে আশপাশে মানুষের জন্য। তাঁরা যেন সুস্থ থাকে ভালো থাকে সে বিষয়ে একটু যত্ন নিতে হবে।
করোনাকালে শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক ভাবে সুস্থ থাকাও কি জরুরি? আপনি কী মনে করেন? আমাদের জানান নীচের কমেন্ট বক্সে। মন্তব্য করুন বাংলা বা ইংরেজিতে।
Health and Fitness Tips in Bengali শরীর-গতিক, Yoga and Exercise Tips in Bangla
2021-06-07 12:35:23
Source link
Leave a Reply