অনেক অভিভাবকই নিজের সন্তানকে এমন স্কিল শেখাচ্ছেন, যা বড় হয়ে সন্তানের কাজে লাগবে। তবে অনেকেই সন্তানকে পরিবেশ সচেতন করে গড়ে তোলার বিষয়টি উপেক্ষা করে যান। কিন্তু বর্তমান যুগের নিরিখে সন্তানকে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে ও যত্ন নিতে শেখানোও খুব জরুরি হয়ে পড়ছে। কারণ নানান সমস্যায় ঘিরে রয়েছে পৃথিবী। পরিবেশের সুস্থতার ওপর মানবজাতির অস্তিত্ব নির্ভর করছে। তাই আর দেরি নয়।
সন্তানকে পরিবেশ সচেতন করে গড়ে তোলার বিষয়টি শুনতে জটিল মনে হলেও, সহজেই এটি করা যায়। ছোটবেলায় বাচ্চাদের পরিবেশ সচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে, ধীরে ধীরে এটিই হয়ে উঠবে তাদের বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস। বর্তমান ও ভবিষ্যতে পরিবেশ সচেতন নাগরিকের প্রয়োজন পড়বে অনেক বেশি। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্দেশে কী ভাবে নিজের সন্তানকে পরিবেশ সচেতন করে গড়ে তুলতে পারেন, তা জেনে নিন—
প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটান
সন্তানকে পরিবেশ সচেতনতার পাঠ পড়ানোর প্রথম ধাপে তাদের প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখান। তাই আবহাওয়া ভালো থাকলে তাদের গৃহবন্দি করে রাখার পরিবর্তে পার্কে ঘোরাতে নিয়ে যান। আবার সন্তানকে মাছ ধরতে উৎসাহী করে তাদের সেখানেও নিয়ে যেতে পারে। সাইকেল চালাতে ভালোবাসলে সন্তানকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন। সাইকেল চালিয়ে ঘুরে আসুন, সময় কাটান প্রকৃতির মধ্যে। সপ্তাহান্তে কোনও মনোরম স্থানে ক্যাম্পিংয়ের জন্য চলে যান। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এর চেয়ে ভালো পন্থা আর দুটি নেই। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বাচ্চারা প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে শিখবে। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বুঝবে। অবশেষে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য প্রকৃতিকে সম্মান জানাতে ও যত্ন নিতে শিখবে।
রিসাইক্লিং
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে পারি। কারণ এর ফলে আমরা যে পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ, বিশেষত নন-বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য ফেলে থাকি, তার পরিমাণ কমানো যাবে। তাই বাড়িতে রিসাইক্লিংয়ের অভ্যাস করুন। কী ভাবে করতে হয় তা সন্তানকে শেখান। আবর্জনা পৃথক করতে শেখান। প্রত্যেকটি ধরণের আবর্জনার জন্য পৃথক ডাস্টবিন রাখা উচিত। তার পর আপনি যখন এই বর্জ্য পদার্থগুলি ডাম্প করতে যাবেন, তখন নিজের সন্তানকে নিয়ে যান। সংগঠিত রিসাইক্লিং কী ভাবে করা হয়, তা তারা শিখতে পারবে।
জল ও খবার সংরক্ষণ করতে শেখান
ফ্রিজে কী ভাবে জল ও খাবার সংরক্ষণ করা যায়, তা-ও ছোট বয়স থেকেই শেখানো শুরু করে দিন। এর সাহায্যে বেঁচে যাওয়া খাবার ফেলে দেওয়ার প্রবণতা এবং অভ্যাস কমানো যাবে।
আবার বাড়িতে জলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। জল নষ্ট করলে কোন কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারি, তা বাচ্চাদের বোঝাতে হবে। প্রতি ফোঁটা জলও যে বাঁচানো উচিত, তার শিক্ষা দিতে হবে সন্তানকে। একটি কাজ হয়ে গেলে কল বন্ধ করতে শেখান। এটা খুব এখটা কঠিন কাজও নয়। দাঁত মাজা ও জিভ পরিষ্কার করার মাঝের সময় হোক বা হাত ধোয়া, শ্যাম্পু করে চুল ধোয়ার পর কন্ডিশনার লাগানোর সময় হোক—দুটি কাজের মাঝখানে যে টুকু সময় থাকে, তাতে জলের কল খুলে রাখার প্রয়োজনীয়তা কী আছে?
জল সংরক্ষণের অপর একটি উপায় হল লো-ফ্লো কল বা লো-ফ্লো এরাটর লাগানো।
পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহারে উৎসাহিত করুন
কোথাও যাওয়ার জন্য সব সময় যে গাড়ি ব্যবহার করতে হবে, এমন কোনও বাধ্যকতা নেই। তাই বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার জন্য বাচ্চাদের হেঁটে যেতে উৎসাহ জোগান। প্রয়োজনে সাইকেলে করে যাওয়ার পরামর্শ দিন। এর ফলে জ্বালানি সাশ্রয় তো হবেই, পাশাপাশি বায়ু দূষণও কমবে। বায়ু দূষণের কুপ্রভাব সম্পর্কে নিজের সন্তানকে ওয়াকিবহাল করান। বোঝান যে, হেঁটে, দৌড়ে বা সাইকেলে কাছেপিঠে গেলে পরিবেশকে সুস্থ রাখার প্রক্রিয়ায় তারা অংশগ্রহণ করতে পারবে।
জীবজন্তুকে ভালোবাসতে শেখান
জীবজন্তুরা দূষণের কারণে ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটিও নিজের সন্তানকে বোঝাতে হবে, তাদের সামনে ব্যাখ্যা করতে হবে এর ভয়াবহতা। পশুপ্রেমী পরিবেশ সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আপনার অল্পবয়সি সন্তানকে বাইরে নিয়ে যান, সে সময় নিজের সঙ্গে কোনও পালিত পশু রাখতে ভুলবেন না। সবচেয়ে ভালো হয় বাড়িতে কুকুর, বেড়াল, পাখি পোষা। মাছের শখ থাকলে বাড়িতে রঙবাহারি মাছও রাখতে পারেন।
নিজের সন্তানকে এই সমস্ত পালিত পশুর যত্ন নিতে শেখান। পোষা কুকুরের সঙ্গে তাদের সখ্যতা গড়ে তুলুন। কোনও এক সকাল বা সন্ধে নাগাদ কুকুরকে বাইরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে বলুন নিজের ছেলে-মেয়েকে। এমনকি বাচ্চাদের চিড়িয়াখানায়ও নিয়ে যেতে পারেন। পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা কতটা জরুরি তা বোঝান তাদের। কারণ এই পরিবেশ দূষের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়ছে পশুপাখীরা এবং তাদের অস্তিত্ব সংকট দেখা যাচ্ছে। যেমন- নদী, সমুদ্র বা জলাশয়ে আবর্জনা ফেলার কারণে মাছেদের ক্ষতি হতে পারে। এ বিষয় প্রত্যক্ষ প্রমাণও পেয়ে যেতে পারেন, তা দেখিয়ে নিজের সন্তানকে পরিবেশ সচেতন করে তোলার চেষ্টা করুন। ছোট বয়স থেকে বাচ্চাদের পরিবেশবান্ধব হওয়ার শিক্ষা দিলে ভবিষ্যতে তারা দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজের আশপাশের পরিবেশকে যত্নে রাখতে পারবে।
বাগান করা
সন্তানকে পরিবেশ সচেতন হিসেবে গড়ে তোলার অন্যতম ভালো উপায় হল, তাদের বাগান করতে শেখানো। ফল, ফুল উৎপন্ন করা এবং মাটির সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দিলে তারা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে পারবে, স্বচ্ছ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করবে।
এ সময় তাদের বর্জ্য পদার্থ রিসাইকেল করে কী ভাবে সার তৈরি করা যায়, তা শেখান। জানান ফেলে দেওয়া শাক, সবজি বা ফলের খোসা ইত্যাদিকে কী ভাবে উদ্ভিদের খাবারের পরিণত করা যেতে পারে। বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য যাতে তারাই কম্পোস্ট পিটে নিয়ে যায় সে বিষয় লক্ষ্য রাখুন। কিছু দিনের মধ্যেই রিসাইক্লিং তাদের পছন্দের বিষয় হয়ে উঠবে। কারণ তাদের লাগানো চারা গাছের বেড়ে ওঠা এবং ফল, ফুলে ভরে ওঠার ক্ষেত্রে এর উপযোগীতা তারা বুঝে যাবে।
বৃক্ষ রোপণ
অল্প বয়স থেকেই নিজের সন্তানকে গাছ প্রেমী করে গড়ে তুলুন। পরিবেশ রক্ষায় গাছের অবদান সম্পর্কে নিজের সন্তানকে জানান। তাই বৃক্ষ রোপণের ওপর জোর দিন। বাচ্চাদের যাতে একঘেয়ে না-লাগে, তার জন্য একে মজাদার অ্যাক্টিভিটিতে পরিণত করুন। সন্তানের প্রতি জন্মদিনে একটি করে গাছ লাগান— এটিকে নিয়মে পরিণত করে দিন। আবার আর্থ ডে-র সময় নানান সংগঠনের তরফে আয়োজিত বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচীতে নিজের সন্তানর সঙ্গে অংশগ্রহণ করুন। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন তাদের গাছের উপকারিতা সম্পর্কে বোঝান। জানান যে, কেন গাছ কাটা উচিত নয়। একটি আর্ট প্রোজেক্টের মাধ্যমেও নিজের সন্তানকে নানান গাছ ও তাদের উপযোগিতা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারেন। এর জন্য গাছের ছবি কেটে প্রোজেক্টের খাতায় লাগান এবং এক এক করে প্রত্যেকের উপকারিতা জানান। এ ভাবে তাদের পরিবেশ সচেতন করে তুলতে পারবেন।
DIY প্রজেক্ট
কার্ডবোর্ড বক্স, টয়লেট রোল, প্লাস্টিক বা কাঁচের বোতল ইত্যাদির রিসাইক্লিং বা রিইউসিংয়ের জন্য একাধিক DIY প্রজেক্ট করতে হবে। বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার একটি মজাদার উপায় এটি। পাশাপাশি তারা এ-ও বুঝতে পারবে যে, এমন অপ্রয়োজনীয় বস্তুকে শিল্প সৃষ্টির কাজে লাগানো যায়। অনলাইনে এমন অনেক প্রোজেক্ট রয়েছে, যার সাহায্যে নিজের সন্তানকে শিক্ষা দিতে পারেন। কোনও অপ্রয়োজনীয় বস্তু ফেলে দেওয়ার আগে তা-ও যে কোনও কাজে ব্যবহার করা যায়, তা তারা উপলব্ধি করতে পারবে।
ঘরে তৈরি ক্লিনিং প্রোডাক্ট ও সলিউশান
কেমিক্যালের পরিবর্তে বাড়িতে তৈরি ক্লিনিং প্রোডাক্ট ব্যবহার করার ওপর জোর দিন। নিশ্চিত করুন যাতে আপনার বাচ্চা আপনাকে এই প্রোডাক্টগুলি তৈরি করতে দেখে এবং আপনার সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। কেমিক্যালযুক্ত সামগ্রীর পরিবর্তে প্রাকৃতিক ও ঘরোয়া প্রোডাক্টের প্রতি তাদের ঝোঁক বাড়ানোর চেষ্টা করুন। যেমন- তাদের সামনেই ভিনিগার ও সোডা বাই কার্ব দিয়ে ঘরের বাথরুম পরিষ্কার করুন। আবার চুল থেকে লিক তাড়াতে ওষুধ বা হেয়ার প্রোডাক্টের পরিবর্তে নারকেল তেল বা অলিভ তেলের মধ্যে টি ট্রি অয়েল মিশিয়ে লাগান। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যে প্রকৃতিই আমাদের প্রদান করে থাকে, তা সন্তান বুঝতে পারবে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
নিজের ঘর, খেলার স্থান পরিষ্কার করতে শেখান তাদের। শুধু তাই নয় বাইরে কিছু খাওয়ার পর কোনও কিছু যাতে তারা পথেঘাটে না-ফেলে দেয়, সে বিষয়ও লক্ষ্য রাখুন। এমন অনেক পাবলিক দেখেছেন নিশ্চয়ই যাঁরা রাস্তাঘাট নোংরা করতে করতে যায়? ছোটবেলায় হয়তো তাঁদের আবর্জনা ফেলা ও পরিষ্কার করার বিষয় উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হয়নি। কিন্তু নিজের সন্তানকে অচিরেই জানিয়েদিন যে যত্র তত্র ময়লা ফেলা একটি বদঅভ্যাস। যে স্থান এবং বস্তু তারা ব্যবহার করেছেন তা পরিচ্ছন্ন রাখা এবং বর্জ্য পদার্থ সঠিক জায়গায় ফেলা কতটা জরুরি, তা তাদের জানা উচিত।
কমিউনিটি প্রোজেক্ট
পরিবেশ রক্ষায় সাহায্য করতে পারে এমন অ্যাক্টিভিটিতে অন্য অভিভাবকদেরও সামিল করুন। গাড়ির ব্যবহার কম করার জন্য কারপুলের ব্যবস্থা করতে পারেন। এর ফলে পথে কম গাড়ি বেরোবে এবং তার ফলে দূষণও কমবে। আবার পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সঙ্গে মিলে বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন। আবার অনেকগুলি বাচ্চাকে নিয়ে প্লে ডেট আয়োজিত করে সেখানে বোতল বা কার্ডবোর্ড বক্স দিয়ে কী ভাবে খেলনা তৈরি করা যায়, তা শেখাতে পারেন।
পরিবেশের ওপর দূষণ ও আবর্জনা কতটা কুপ্রভাব বিস্তার করেত পারে, এই সুযোগে সে বিষয় কঠিন বাস্তবও তাদের সামনে তুলে ধরুন। কোনও মজাদার অ্যাক্টিভিটির সময় এমন তথ্য প্রদান করলে, তা তাদের মস্তিষ্ক সহজে গ্রহণ করবে এবং স্থায়ী হবে।
পরিবেশ রক্ষার বিষয় তৈরি কার্টুন ও সিনেমা দেখুন
সন্তানের টিভি টাইমও তাদের শিক্ষা দেওয়ার কাজে লাগান। বাচ্চার জন্য এমন অনেক ভিডিও ও কার্টুন রয়েছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর তৈরি। আপনার সন্তান যাতে এ ধরণের কার্টুন বা ভিডিও দেখে তা নিশ্চিত করুন। এর মাধ্যমেও তারা অনেক কিছু শিখতে পারবে। পরিবেশ রক্ষার ওপর রচিত গল্প বা কমিক বই কিনতে পারেন। পরিবেশকে কী ভাবে সম্মান জানানো এবং তাকে সুস্থ রাখা যায়, সে সবই বাচ্চারা এগুলির মাধ্যমে শিখতে পারবে।
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-06-05 11:23:15
Source link
Leave a Reply