১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস
শিশু ও তরুণদের ডায়াবেটিস সচেতনতা
বছর ঘুরে ১৪ নভেম্বর আসে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। এদিন জ্ন নিয়েছিলেন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেনটিং, যিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে আবিষ্কার করেছিলেন ইনসুলিন। এ দিবসটি তাই খুব তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় তাগিদ অনুভব করেছিল বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমন এক সচেতনতা অভিযানের সূচনা করার, যা সারা বিশ্বে প্রতিপালিত হবে।
১৪ নভেম্বর ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে নির্বাচিত হলো ১৯৯১ সালে এবং তখন থেকে এ দিবস পালন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশ্বের ১৬০টি দেশে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির জোরালো তাগিদ সৃষ্টি হতে লাগল। শিশু ও বয়স্ক, যারাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, স্বাস্থ্য পরিচর্যার সঙ্গে যুক্ত সবাই, নীতিনির্ধারক ও গণমাধ্যম সবাই এতে সম্পৃক্ত হলেন। এ দিনটি নানা অনুষ্ঠান, প্রবন্ধ প্রকাশ, গণমাধ্যমে প্রচার, খেলাধুলা, সব ধরনের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়।
প্রতিবছর এ দিবসটি পালনের জন্য একটি প্রতিপাদ্য বিষয় (থিম) নির্ধারণ করা হয়। অতীতে ডায়াবেটিস ও স্থূলতা, ডায়াবেটিস ও পায়ের পরিচর্যা, ডায়াবেটিস ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ-এসব বিষয় নিয়ে দিনটি পালিত হয়েছে।
২০০৭ সালে স্থির হলো, অভিযান পরিচালনার থিমটি আরও দীর্ঘ সময় ধরে থাকবে। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০০৭-০৮-এর থিম নির্ধারিত হলো ‘শিশু ও তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিস’। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের থিম নির্ধারিত হয়েছে, ‘ডায়াবেটিস শিক্ষা ও প্রতিরোধ’।
২০০৭-০৮ সালে এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হলো-আরও বেশি শিশু ও তরুণকে এই পরিচর্যার আওতায় আনা। ডায়াবেটিসের জরুরি সংকেত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
এ রোগের একটি জটিলতা ‘ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস’ হ্রাস করার উদ্যোগ উৎসাহিত করা। আর শিশুদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনকে আরও জনপ্রিয় করে তোলা।
এ দিবসের নীল বৃত্তের ‘লোগো’টি ডায়াবেটিসকে পরাভূত করার জন্য বিশ্বব্যাপী লড়াইয়ের সূচক। লক্ষ্য হলোঃ পৃথিবীতে কোনো শিশুই যেন ডায়াবেটিসে মারা না যায়।
ডায়াবেটিসের মতো ক্রনিক রোগ ব্যক্তি, পরিবার, দেশ, এমনকি সারা পৃথিবীর জন্য গুরুতর ঝুঁকি বহন করে-এমন সত্যটি জাতিসংঘ অনুধাবন করে ২০০৬ সালে একে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিল।
পৃথিবীতে ২৫০ মিলিয়ন লোক ডায়াবেটিস নিয়ে জীবন যাপন করছে। তাই এ রোগকে লড়াই করে পর্যুদস্ত না করলে পরবর্তী প্রজন্ম তা বেড়ে ৩৮০ মিলিয়ন হতে পারে। ডায়াবেটিস একটি ক্রনিক রোগ।
আমরা জানি, দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে হয় ডায়াবেটিস। ইনসুলিনের ঘাটতি হলো মূল কথা। অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিন, যার সহায়তায় দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজকে নিতে সমর্থ হয় এবং একে শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে। ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিনের কাজ করার ক্ষমতা-এর যেকোনো একটি বা দুটোই যদি না হয়, তাহলে রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজ। আর একে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঘটে নানা রকম জটিলতা, দেহের টিস্যু ও যন্ত্র হতে থাকে বিকল।
ডায়াবেটিস প্রধানত দুই রকমের। টাইপ-১ ডায়াবেটিস হলো অটোইম্যুন রোগ। এ রোগে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। তাই যাদের টাইপ-১ হয়, এদের দেহে ইনসুলিন উৎপাদিত হয় খুবই কম। এ জন্য রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প নিতে হয়। শিশু ও তরুণদের মধ্যে এ ধরনের ডায়াবেটিস হয় বেশি।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের পেছনে থাকে মূলত ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’।
টাইপ-২ রোগীরা শরীরে যে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়, একে ব্যবহার করতে পারে না। ব্যায়াম ও খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন।
বিশ্বজুড়ে ২৪৬ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস। দুই ধরনের ডায়াবেটিসই গুরুতর এবং হতে পারে শিশু ও তরুণদেরও। এ জন্য ডায়াবেটিসের বিপদ-চিহ্নগুলো জানা খুবই প্রয়োজন। ‘মৃদু ডায়াবেটিস’ বলে
কিন্তু কিছু নেই।
শিশু কি ঝুঁকিতে আছে?
ডায়াবেটিসের জরুরি সংকেতগুলো হলো-
–বারবার প্রস্রাব হওয়া
–অতিরিক্ত পিপাসা
–বেশি ক্ষুধা লাগা
–ওজন হ্রাস
–ক্লান্তি
–মনোযোগ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যাওয়া
–ঝাপসা দৃষ্টি
–বমি ও পেটব্যথা (কখনো একে ফ্লু বলে ভ্রম হয়)।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস শিশুদের মধ্যে এসব লক্ষণ মৃদু হতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। ডায়াবেটিস একটি ক্রনিক, জীবনভর রোগ; যার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা না হলে রক্তে সুগার খুব বেশি বেড়ে যেতে পারে। হতে পারে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক। কিডনি বিকল হতে পারে, প্রয়োজন হতে পারে কিডনি ডায়ালিসিস বা ট্রান্সপ্লান্ট। স্মায়ুর ক্ষতি হয়ে পায়ে ঘা হতে পারে, অনেক সময় অঙ্গচ্ছেদ করতে হতে পারে। হতে পারে অন্ধত্ব।
ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস
টাইপ-১ ডায়াবেটিস চিকিৎসা না হলে বা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হতে পারে জীবনসংশয়ী জটিলতা-ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস (ডিকেএ)। দেহে এত কম ইনসুলিন থাকে যে দেহকোষ গ্লুকোজকে শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে না। তখন শরীর তার পরবর্তী জ্বালানি সম্পদ মেদকে ভাঙতে শুরু করে। মেদ ভাঙার ফলে উৎপন্ন হয় অম্ল বর্জ্য, যাকে বলা হয় কিটোন। এভাবে শরীরের রাসায়নিক ভারসাম্য নষ্ট হতে থাকে। শরীরের কিটোন জমা হতে থাকে, শুরু হয় দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন বাড়ে, শ্বাসে পাওয়া যায় ফলের গন্ধ, পেটে হয় প্রচণ্ড ব্যথা, বমি অবসাদ-ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসের সূচনা এভাবেই।
বিশ্বজুড়ে টাইপ-১ ডায়াবেটিক শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো ডিকেএ বা ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস। চিকিৎসা না হলে মৃত্যু অবধারিত। মগজে পানি জমে পরিণামে মৃত্যু।
আগাম এসব লক্ষণ শনাক্ত করা গেলে প্রতিরোধ সম্ভব। রক্তে উঁচু মানের শর্করা নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে বিপত্তি ঘটে।
তাই জরুরি লক্ষণগুলো জানা দরকার। টাইপ-১ ডায়াবেটিসের একটি লক্ষণ, যা নির্ণয়ে ব্যর্থতা দেখা যায় তা হলো, বিছানায় অস্বাভাবিক প্রস্রাব। এটি এবং ডায়াবেটিসের অন্য জরুরি সংকেতগুলো জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের যেকোনো বয়সে হতে পারে ডায়াবেটিস। রোগনির্ণয় জরুরি এবং প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা ও ইনসুলিন দেওয়ার ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আরও সজাগ হতে হবে। দরিদ্র দেশে সম্পদ ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার জন্য ইনসুলিন পৌঁছাতে পারে না এসব হতভাগ্য শিশুর কাছে।
শিশু ও তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিস বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিক রোগী ২৫০ মিলিয়নের ওপরে। ২০ বছরে এ রকম চললে তা বেড়ে হতে পারে ৩৮০ মিলিয়ন। বিশ্বজুড়ে ১৫ বছরের নিচে ৭০ হাজার শিশু প্রতিবছর টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ১৪ বছরের নিচে চার লাখ ৪০ হাজার টাইপ-১ শিশুর মধ্যে ২৫ শতাংশ রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস শিশুদের মধ্যে আগামী ১৫ বছরে ৫০ শতাংশ হারে বাড়বে বলে ধারণা।
বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা-সুবিধার আওতায় তেমন না থাকায় ইনসুলিন সরবরাহ ও রক্তের সুগার তদারকির যন্ত্রপাতির অভাবে শিশুরা হুমকির মুখে। অনেক দেশে ডায়াবেটিসকে এখনো মনে করা হয় বড়দের রোগ। তাই শিশুদের রোগনির্ণয় ঘটে দেরিতে, গুরুতর পরিণতির দিকে যায় এরা।
অথচ একে প্রতিরোধ করা যায়। উপযুক্ত পরিচর্যা, ওষুধের আওতায় আনা, শিক্ষা, সচেতনতা বাড়ানো, সাহায্য অবলম্বন-এসব দিলে ডায়াবেটিক শিশুরা পাবে পরিপূর্ণ ও সুস্থ জীবন। শিশুদেরও ডায়াবেটিস হয়, ধরনও আলাদা।
নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে জটিলতা ঘটে অনেক আগে, কম বয়সে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস যাদের, তাদের জন্য ব্যায়াম, খাদ্যবিধি, স্থূলতা কমানো-এসব জরুরি। যেসব শিশুর ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ওষুধ, সহায়তা, শিক্ষা যা কিছু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন, তা জাতি, বর্ণ, দেশ-নির্বিশেষে পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ জন্য স্কুল-কলেজে এদের জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা। এদের জন্য চাই ইনসুলিন, রক্তের সুগার মাপার যন্ত্র, চিকিৎসক-সুবিধা, এইচবি১সি টেস্ট, ডায়াবেটিস সচেতনতা শিক্ষা, চিকিৎসক-সহায়তা। বিশ্বজুড়ে শিশুরা যদি সমান সুবিধা পায়, তাহলে এ দিবস পালন সার্থক হবে।
অধ্যাপক ডা· শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক
ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১২, ২০০৮
Leave a Reply