আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে কয়েক তরুণ গাইছে দেশের গান। হাতে গিটার, আগুনের আভায় মুখগুলো উজ্জ্বল। সেটা দেখে একজন মুক্তিযোদ্ধা যেন ফিরে গেলেন তাঁর সময়ে। যুদ্ধের ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধারা বসে গাইছেন একই গান।
এটা একটা বিজ্ঞাপনচিত্রের দৃশ্য। এর বক্তব্য একদমই খাঁটি। তরুণেরা বদলায়নি। দেশের গান নিয়ে ‘জাগরণের গান’ শীর্ষক সিডির প্রকাশনা উত্সবে দেখা গেল জাতীয় পতাকা হাতে অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে। তারা নেচেছে, গেয়েছে, হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। এটা তো দেশকে ভালোবাসাই, নয় কি?
তাদের দেশপ্রেমের প্রকাশটা হয়তো ভিন্ন। কিন্তু এই অনুভূতি তো তাদের আছে। দেশি পণ্য ব্যবহার, দেশি গান শোনার যে প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা যায়, তা তো দেশের প্রতি একরকম ভালোবাসাই বলা যায়।
‘দেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য’—একসময়ের এ স্লোগান হুবহু হয়তো অনেক তরুণ জানেও না। কিন্তু কাজটা তারা ঠিকই করছে। ফেব্রুয়ারিতে সাদা-কালো, মার্চে লাল-সবুজ, বৈশাখে লাল-সাদা আবার ডিসেম্বরে লাল-সবুজ। এ রকম ঐতিহ্য আর ইতিহাসের কথা মনে রেখে পোশাক পরেন অনেকেই। ডিসেম্বর মাসটা মোবাইল ফোনের ওয়েলকাম টিউনে দেশের গান, ফেইসবুকের প্রোফাইল ছবিতে জাতীয় পতাকা, পরনে মুক্তিযুদ্ধের থিমভিত্তিক পোশাক—এমন তো অনেককেই দেখা যাচ্ছে। একে কি আমরা দেশপ্রেম বলব, নাকি নিছক খেয়াল ভেবে উড়িয়ে দেব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী রাহাত মিনহাজের সঙ্গে কথা হয়। ‘আমি সব সময় দেশি পোশাকই পরি। দেশি পোশাকটা মনে হয়, যেন একদম আমার নিজের। এটা আমার নিজের দেশে তৈরি, নিজের সংস্কৃতির প্রকাশটা এর মধ্যে পাই। এই নিজ ভাবটাই আমাকে টানে। আর এগুলো দামে সাশ্রয়ী, পরতে আরামদায়ক, ডিজাইনও খুব সুন্দর। একটা টি-শার্টে হয়তো জয়নুলের একটা চিত্র থেকে নকশা করা হলো। সেটা কিনে পরা হলে আমি এই চিত্রটা দেখলাম, আমার বন্ধুরাও দেখতে পেল। এভাবে অনেক নতুন জিনিসও জানা হয়, দেখা হয়। দেশের তৈরি কাপড় কিনে আমি এভাবে অর্থনীতিতেও কিছুটা সাহায্য করছি। এ ভাবনাটাও মনে আসে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের জিনিস মানে, আমার নিজের জিনিস। এটা আমি পরব না তো কে পরবে।’
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাসনিম ফারহানা বলেন, ‘জিনসের সঙ্গে আমি যখন একটা বাংলাদেশি ফতুয়া পরছি, তখন সেটা আর পাশ্চাত্যের পোশাক থাকছে না। সেটা একরকম আমার নিজের দেশের পোশাকই মনে হচ্ছে। পাশাপাশি ফ্যাশনটাও বেশ চমত্কার।’
বিদেশি আদলে দেশে তৈরি পোশাক নয় বা বিদেশি কাপড় কেটে দেশি ঢঙে তৈরি পোশাক নয়। বরং এখনকার ফ্যাশন হাউসগুলোর পোশাকে কাপড়ের বুনন, নকশা, রং সব মিলিয়ে শতভাগ দেশি ভাবটাই ফুটে ওঠে। এই দেশি ছাপটাই এখন আমাদের বৈশিষ্ট্য। বর্ষার কদম ফুল, নৌকা, হেমন্তের ধান, হাতপাখা, পিঠাপুলি থেকে শুরু করে শহরের যানজট, ঘন অট্টালিকার সারি, রিকশা—সবই ব্যবহূত হচ্ছে পোশাকের মোটিফ হিসেবে। আর বিশেষ দিবসে থিমভিত্তিক পোশাকও প্রচুর হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পোস্টার, স্লোগান, দেশাত্মবোধক গানের লাইন, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে প্রকাশিত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা, অনেক কিছুই ব্যবহূত হচ্ছে পোশাকের নকশায়। আর জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রং তো আছেই। ফ্যাশন হাউস দেশালের ডিজাইনার ও স্বত্বাধিকারী কনক আদিত্য বলেন, ‘এ ধরনের ডিজাইন আমি নিজের তাগিদ থেকেই করি। আমি যেটা জানি, সেটা অন্যকেও জানাতে চাই। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল সচরাচর দেখা যায় না। আমি যখন এটা দেখলাম, তখন মনে হলো, এটা পোশাকে ব্যবহার করলে তো আরও অনেকেই দেখতে পাবে। আর স্থানীয় চিত্রকলা (লোকাল আর্ট) নিয়ে আগে থেকেই আগ্রহ ছিল। সেটা শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশের লোকাল আর্টও আমি আমার ডিজাইনে এনেছি। তরুণদের ক্রয়ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে আমরা দাম নির্ধারণ করি। ফলে সেটা সাশ্রয়ী হয়। তবে অন্য সব কারণ ছাপিয়েও আমার মনে হয়, তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের বোধটা আছে বলেই তারা এসব কেনে।’
দেশের পোশাক তো পরা হচ্ছেই। দেশের গানের বেলায় চিত্রটা কেমন? এফএম রেডিও চ্যানেলগুলো শুনলে অবশ্য মনে হয় তরুণদের বাংলা গানের প্রতি আগ্রহ ব্যাপক। এবিসি রেডিওর কথাবন্ধু পম্পা বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম আসলে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের গাওয়া গান শুনতেই বেশি পছন্দ করে। এক-দুবার শোনার পর যে গানটা ভাল লাগে, সেটাই বারবার শুনতে চায়।’
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান নিয়ে বের হচ্ছে একটি সংকলিত সিডি। এর সংগীতায়োজন করেছেন পার্থ বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘এই গানগুলোর কথা ও সুর এত সমৃদ্ধ যে এটা তরুণদের পছন্দ হবেই। এই অ্যালবামে মূল শিল্পীদের গান আছে। কিছু গান ক্লোজআপ ওয়ানের শিল্পীদের দিয়ে নতুন করে গাওয়ানো হয়েছে। তখন আমি ওদের মধ্যে যে আবেগ দেখেছি, তা অবিশ্বাস্য। ওরা তো এ প্রজন্মেরই ছেলেমেয়ে। সেই আবেগ আশা করি অন্যদের মধ্যেও পাব।’
কনক আদিত্য নিজে গান করেন। তিনি বলেন, তরুণদের অনেকের মধ্যে হিন্দি গান শোনার প্রবণতা এখনো অনেক বেশি। বিজয়ের মাসে, স্বাধীনতার মাসে হয়তো দেশের গান শোনে তারা। তবে বছরের বাদবাকি সময় তা আর হয় না। আর এখন যেসব গান হচ্ছে, তাকে বিদেশি ধাঁচের বাংলা গান বলাই ভালো। শুধু ভাষাটা বাংলা। একে তো আর দেশের গান বলা যায় না।
তরুণ কণ্ঠশিল্পী রন্টি দাস বলেন, ‘দেখা যায় পুরোনো বাংলা গানের মূলটা কেউ তেমন পছন্দ করছে না। কিন্তু রিমিক্স করা হলে ওই গানটাই খুব জনপ্রিয় হচ্ছে। আবার অন্যটাও দেখা যায়, হায়দার হোসেন, সায়ান যেসব গান করছেন, সেগুলো তো বক্তব্যধর্মী, সিরিয়াস। সেগুলোও তো অনেকে শুনছে। আসলে গান ভালো হলে সবাই শুনবে। আর আমরা কিন্তু সেই পুরোনো দেশাত্মবোধক গানগুলোই বারবার গেয়ে যাচ্ছি। এ সময়ের প্রেক্ষাপটে আরও নতুন নতুন দেশের গান হওয়া দরকার।’
সময় বদলেছে, কিন্তু আমাদের অনুভূতি বদলায়নি। বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে তরুণদের দেশপ্রেমের প্রকাশটা হয়তো ভিন্ন হচ্ছে। কিন্তু দেশপ্রেম তো আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পোস্টার দিয়ে নকশা করা টিশার্ট গায়ে আজকের যে তরুণ গিটার বাজিয়ে গায় ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু…’ তার পদভারেই একদিন জন্ম নেবে নতুন পৃথিবী।
রুহিনা তাসকিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৫, ২০০৯
Leave a Reply