ডায়াবেটিস হলেই হতাশ হবেন না
‘তানিয়াকে আমি কীভাবে বলব এই সত্য কথাটা? ও যখন জানতে পারবে আমার ডায়াবেটিস, তখন ও কি আর আগের মতো ভালোবাসবে আমাকে? নাকি করুণা করবে? কিন্তু আমার এই ডায়াবেটিস রোগের জন্য তো আমি দায়ী নই। আর ওর বাবা-মা কি কখনো চাইবেন, একজন শারীরিক অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে? আমি কি বিষয়টি গোপন করব?
কিন্তু তাও তো হবে প্রতারণার শামিল। বুঝতে পারছি না আমি কী করব। তবে আমার এই অভিশপ্ত জীবনের সঙ্গে আমি তানিয়াকে কখনো জড়াব না। আমি চলে যাব ওর থেকে অনেক দূরে।’
এ আত্মটীকাটি একজন ডায়াবেটিস রোগী শাহাদত (ছদ্মনাম)-এর ডায়েরি থেকে সংগ্রহ করা। তিনি তাঁর প্রিয় মানুষটির কাছে বিষয়টি গোপন করেন এবং পরবর্তী সময়ে চরম বিষণ্নতা বা হতাশায় আক্রান্ত হন।
হতাশাগ্রস্ততা (ডিপ্রেসিভ ইলনেস) একটি মানসিক রোগ। সাধারণত হীনম্মন্যতা থেকেই এর উৎপত্তি হয়। ধীরে ধীরে তা প্রভাবিত করে চিন্তা, আচার-আচরণ, মানসিকতা ও ব্যবহারকে। বাড়িতে, স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে-সব জায়গায়ই আসে অনীহা আর বিরূপতা। এমনকি জ্ন নিতে পারে মদ্যপান বা মাদকাসক্তির মতো সামাজিক ব্যাধি।
বিভিন্ন কারণেই হতাশাগ্রস্ততা হতে পারে। যেমন-শারীরিক অক্ষমতা, পারিবারিক সমস্যা, সাময়িক সংকটময় পরিস্থিতি এবং হার্ট অ্যাটাক, ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো ব্যাধি। ডায়াবেটিসের কারণে যে হতাশাগ্রস্ততার উৎপত্তি হয়, তা মূলত অজ্ঞতা থেকেই।
স্বভাবতই সদ্যনির্ণীত একজন ডায়াবেটিস রোগী মনে করে, তার জীবনযাত্রা হয়ে গেল সংকীর্ণ, প্রতিটি পদেই তাকে মুখোমুখি হতে হবে প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার। স্বাভাবিকভাবেই সে গুটিয়ে নেয় নিজেকে সবার থেকে এবং এভাবেই জ্ন নেয় বিষণ্নতা, আর তা থেকে শুরু হয় হতাশাগ্রস্ততা। গবেষকদের মতে, একজন ডায়াবেটিস রোগীর বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একজন সুস্থ ব্যক্তির চেয়ে অনেক বেশি। গবেষণায় দেখা যায়, টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মোট সংখ্যার প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশই হতাশাগ্রস্ততায় আক্রান্ত। মেয়েদের মধ্যে এ হার পুরুষের চেয়ে বেশি। শুধু তা-ই নয়, ২০০২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিষণ্নতায় একজন ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসার খরচ একজন সাধারণ ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা খরচের প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
বিষণ্নতার কারণে একজন ডায়াবেটিস রোগী তার রক্তের সুগার পরীক্ষা থেকে শুরু থেকে সবকিছুতেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, জীবনযাত্রার নিয়মানুবর্তিতায় পায় না কোনো উৎসাহ। শুরু হয় অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, ওষুধ বা ইনসুলিন নেওয়ায় অনিয়ম, শারীরিক ব্যায়ামে অনীহা এবং সর্বোপরি নিজের ওপর অযত্ন। তাই যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে মানসিক রোগ ও স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। দরকার সঠিক কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপির। বিষণ্নতার সাধারণ লক্ষণগুলো হলো-
–দীর্ঘ সময় ধরে দুশ্চিন্তা, দুঃখ ভাব বা মানসিক শূন্যতা।
–আত্মগ্লানি, অসহায়ত্ব।
–দৈনন্দিন পারিবারিক, ব্যক্তিগত বা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিরুৎসাহ, বিষাদগ্রস্ততা।
–অমনোযোগিতা, ্নৃতিশূন্যতা, সিদ্ধান্তহীনতা।
অনিদ্রা, ক্ষুধামান্দ্য, শারীরিক ওজনে ভারসাম্যহীনতা।
–অস্থিরতা, খিটখিটে মেজাজ ও আত্মহত্যার প্রবণতা।
–মাদকাসক্তি।
এই লক্ষণগুলো যে-কারও মধ্যেই দেখা দিতে পারে। কিন্তু যদি তা দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে প্রকাশ পায়, তাহলে অবশ্যই সেই ব্যক্তি হতাশাগ্রস্ততা নামক মারাত্মক মানসিক রোগে আক্রান্ত।
যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়গুলো নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। সঠিকভাবে কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি আর কাছের মানুষের সহানুভূতি-সহযোগিতাই পারে একজন হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে সুশৃঙ্খল, সুনিয়ন্ত্রিত ও সুন্দর জীবনের সন্ধান দিতে।
ফিরে যাই শুরুর সেই আত্মকাহিনীতে। শাহাদাতকে কিন্তু হতাশার আত্মগ্লানিতে হারিয়ে যেতে হয়নি। তানিয়া তাকে ভুল বোঝেনি। বরং বাড়িয়ে দিয়েছিল সহমর্মিতার হাত। কারণ, সে জানত সঠিকভাবে জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা মেনে চললে ডায়াবেটিস কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়, বরং জীবনে নিয়মানুবর্তিতা পালনের উদ্দীপনা।
আসুন না, আমরাও আমাদের কাছের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীটির প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিই।
ডা· মো· মাহফুজুর রহমান
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১২, ২০০৮
Leave a Reply