দীর্ঘমেয়াদি কাশি
সাধারণত সর্দিজ্বর বা ঠান্ডা লাগলে সবারই কমবেশি কিছুটা কাশি হয়। কখনো শুকনো, কখনো বা সামান্য কফও বের হয়। ফ্লু-জনিত বা গলায় সামান্য প্রদাহের কারণে কাশি তেমন অসুবিধার সৃষ্টি করে না, দু-চার দিন পর উপশম হয় এবং কাশির জন্য খুব বেশি ওষুধের দরকারও হয় না। কিন্তু কিছু রোগে কাশি একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দেয় এবং বেশ কয়েক দিন কাশি থাকে। কাশি রোগ নয়, কিন্তু রোগের উপসর্গ। এ জন্য সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে ওষুধ খেলে দীর্ঘমেয়াদি কাশি ভালো হয়ে যায়।
দীর্ঘমেয়াদি কাশিঃ যে কাশি একনাগাড়ে তিন সপ্তাহের বেশি থাকে, তাকেই দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক কাশি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেসব রোগে দীর্ঘমেয়াদি কাশি হয়, সে সম্পর্কে কিছুটা জানা থাকলে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় সুবিধা হয়। ক্রনিক কাশি হলে কারও কারও কাশির শেষে কিছুটা টানের ভাব থাকে, কখনো বা শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। শিশুদের ক্রনিক কাশি থাকলে দেরি না করে কাছাকাছি চিকিৎসাকেন্দ্রে বা স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে। বয়স্ক ও যারা কোনো রোগে শয্যাশায়ী, তাদের ক্রনিক কাশি হলে সত্বর প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি কাশি হচ্ছে রোগের উপসর্গ, রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে কাশিজনিত রোগ পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়।
হাঁপানি বা অ্যাজমাঃ হাঁপানি সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই কিছুটা ধারণা আছে। এই রোগে দীর্ঘমেয়াদি কাশি একটি প্রধান উপসর্গ। সাধারণত দুই বছরের কমবয়সী শিশুদের হাঁপানি বা অ্যাজমা দেখা যায় না। দু-একজন শিশুর কখনো বা হাঁপানি দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে হাঁপানির ইতিহাস থাকে। হাঁপানির কারণে যে ক্রনিক কাশি হয় তার লক্ষণ হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট মৌসুমে বা রাতের বেলায় খুব বেশি বা ঘন ঘন কাশি, বেশি নড়াচড়া করলে কাশি বেড়ে যায়, অনেকক্ষণ কাশির পরে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, আক্রান্ত রোগী মুখ দিয়ে শ্বাস নিয়ে থাকে, নাকের দুই পাশ ও বুকের পাঁজর ঘন ঘন ওঠানামা করে। ঘন ঘন কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সালবিউটামল ওষুধ বা ইনহেলার ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায়। রোগটি হাঁপানি বলে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিলে দীর্ঘমেয়াদি কাশি থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।
যক্ষ্মাঃ টিউবারকুলোসিস হলে দীর্ঘমেয়াদি কাশি দেখা যায়। শুধু দীর্ঘমেয়াদি কাশি থাকলেই ফুসফুসের যক্ষ্মা বলা যাবে না, সঙ্গে অনেক দিন ধরে শরীরে অল্প জ্বর, শরীরের ওজন কমে যাওয়া, ঘাড়ের লিম্ফনোড বা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকলে বুকের যক্ষ্মা বলে সন্দেহ করা যেতে পারে। বুকের যক্ষ্মা থাকলে ক্রনিক কাশি একটি প্রধান উপসর্গ। এ ক্ষেত্রে বুকের এক্স-রে, কফ ও মনটুস পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করে নিয়মিত ওষুধ খেলে বুকের যক্ষ্মা পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়; সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কাশি থেকে নিরাময় পাওয়া যায়।
হুপিং কাশিঃ হুপিং কাশির জন্য ডিপিটির পি অর্থাৎ পারটুসিস বা হুপিং কাশির প্রতিষেধক নেওয়ার পরও কোনো কোনো শিশুর সামান্য হুপিং কাশি দেখা দিতে পারে। লক্ষ রাখতে হবে, শিশুর কাশির সময় টান বা হুপ শব্দ হয় কি না, কাশতে কাশতে বমি করে কি না এবং শ্বাসকষ্ট হয় কি না।
শিশুদের ডিপিটির সব ডোজ সঠিক সময়ে না দিলে হুপিং কাশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং শিশু ক্রনিক কাশিতে ভোগে। চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুকে ডিপিটির প্রতিষেধক টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। সাধারণত ১২ বছর বয়সের পর শিশুদের হুপিং কাশি দেখা যায় না। বর্তমানে স্বাস্থ্যসচেতনতার জন্য টিকা ব্যবহার অনেক বেড়েছে বলে রোগটি প্রায় নিয়ন্ত্রিত এবং এখন খুব বেশি শিশু হুপিং কাশিতে আক্রান্ত হয় না।
ব্রংকিয়্যাকটেসিসঃ এ রোগটি সাধারণত শিশুদের হতে দেখা যায় না। আমাদের দেশে বয়স্ক পুরুষদের মধ্যেও এটি বেশি দেখা যায়। ঘন ঘন ফুসফুসের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, ফুসফুসে পুঁজ প্রভৃতি কারণে এ রোগ হয়। এই রোগটির অন্যতম প্রধান উপসর্গ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি কাশি। ব্রংকিয়্যাকটেসিস হলে বিচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘস্থায়ী কাশি হয়। সাধারণত সকালের দিকে কাশি বেশি হয়, কাশির রং সচরাচর সবুজ হয় এবং গন্ধযুক্ত কফে পুঁজ থাকে। রোগটি নির্ণয়ের জন্য বুকের এক্স-রে এবং কিছু পরীক্ষার দরকার হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেলে রোগটি সেরে যায়।
আরও কিছু কারণঃ শ্বাসনালির লিম্ফনোড বা গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে বাইরের কোনো বস্তু ফুসফুসে বা শ্বাসনালিতে ঢুকলে ক্রনিক কাশি হতে পারে। খুব বেশি বা দীর্ঘদিন ধূমপান করলেও অনেকের ক্রনিক কাশি দেখা যায়। ক্রনিক কাশির উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ খেলে পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। তবে তিন-চার দিনের কাশিকে ক্রনিক কাশি ভেবে কোনো ওষুধ খাবেন না।
ডা· রেজাউল ফরিদ খান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১২, ২০০৮
Leave a Reply