সমস্যা: আমার বয়স ১৮। সমস্যাটা আজ থেকে তিন বছর আগে শুরু, তবে এখন বেশি প্রবল। আমার মনে সব সময় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব কাজ করে। মাথা থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতেও পারি না। এ দ্বন্দ্বের কারণে মনে অপরাধবোধ কাজ করে। সব সময় মনে হয়, আমাকে এ জন্য বড় বিপদে পড়তে হবে। কেউ আমার ক্ষতি করতে পারে, অপমান করতে পারে। আমার মন সব সময় আমার ইচ্ছা ও যুক্তির বিপক্ষে কাজ করে। এটা আমার জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। শুধু এটা নয়, অন্য কোনো চিন্তা মাথায় ঢুকলেও তা মাথা থেকে বের করতে পারি না। মনে খুঁতখুঁতে ভাব বিরাজ করে। এসব চিন্তা করতে করতে অনেক সময় মাথা কাজ করে না। পড়ার টেবিলে বসলে সমস্যাটা আরও প্রবল হয় এবং সেদিন পড়তে পারি না। এসব চিন্তা আমার অবচেতনেও কাজ করতে থাকে। তিন বছর ধরে এভাবে চিন্তা করতে করতে স্মৃতিশক্তি একদম দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতিপরিচিত কারও নাম বা পড়া মনে করতে পারি না। অথচ আমি এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছি। স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ায় আমি আরও বেশি চিন্তিত।
নাহিয়ান জামান
শেরপুর।
পরামর্শ: তোমার মনে যা ঘটছে, তা তুমি ইচ্ছে করে মোটেও ঘটাচ্ছ না। তুমি অবসেশনে ভুগছ বলেই এই চিন্তাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে তোমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে চলতে গিয়ে নানা ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে পড়তে হয়। তবে এই চাপগুলো সামলানোর মতো ক্ষমতা সবার মধ্যে একই রকম থাকে না। আর যাদের ভেতরে ক্ষমতা কম রয়েছে, তাদের এ জন্য দায়ীও করা যায় না। কারণ কোনো একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক কীভাবে তৈরি হবে, সেটি তার জেনেটিক এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল।
আমরা যারা এই কষ্টগুলো নিতে গিয়ে বিপর্যস্ত হচ্ছি, তাদের নানা রকম মানসিক অসুবিধা বা অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত অবসেশন তার মধ্যে একটি। তোমার মধ্যেও যদি মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতা কম থাকে, সেটির জন্য তুমি কিন্তু দায়ী নও। তাই নিজেকে অপরাধবোধগুলো থেকে যদি মুক্ত করতে পার, তা হলে খুব ভালো হয়। তোমার শিশুসত্তা বা আবেগীয় সত্তার সঙ্গে যুক্তিপূর্ণ সত্তাটির কথোপকথন হওয়া দরকার। প্রথমে নিজের ভেতরের আবেগের দিকটিকে ক্ষমা করে দিও, এই অবান্তর চিন্তাগুলো করার জন্য। তার পর তোমার মনের যুক্তিপূর্ণ দিকটি ব্যবহার করবে। নিজের মনকে বলবে—‘শক্তি, সাহস, ভালোবাসা নিয়ে আমি পথ চলার অনুপ্রেরণা খুঁজে নেব।’ প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে, তোমার শরীর আর মনকে যথেষ্ট রিলাক্স দিয়ে, আবেগীয় সত্তার সঙ্গে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার অনুভূতি নিয়ে এবং নিজের নামটি নিজেই মনে মনে উচ্চারণ করে ধৈর্যের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলবে। কারণ আমরা যদি আমাদের অনিচ্ছাকৃত বিষয়গুলোর জন্য নিজেকে সারাক্ষণ বেত্রাঘাত বা দোষারোপ করতে থাকি, তা হলে নিজের প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করা হয়। তোমার স্মৃতিশক্তি আসলে ঠিকই আছে। একটি বিষয় নিয়ে বেশি ভাবলে যা ঘটে তা হচ্ছে, আমাদের প্রচুর মানসিক প্রাণশক্তি ব্যয় হয়ে যায়। এর ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলোর কার্যকারিতা কিছুটা কমে গেছে বলে মনে হয়। তুমি যখন সুস্থ হবে, তখন এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবনা আর ভাবতে হবে না। তখন তোমার স্মৃতিশক্তিসহ অন্য ক্ষমতাগুলো ভালোভাবে কাজ করবে। এ ছাড়া সমস্যার বিষয়টি নিয়ে তুমি যে সচেতন, সেটি অত্যন্ত ইতিবাচক। তিন বছর ধরে তুমি যেহেতু কষ্ট পাচ্ছ, আমার অনুরোধ থাকবে ঢাকায় এসে তুমি কোনো সাইকোথেরাপিস্ট বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছ থেকে বেশ কয়েকটি সেশন নাও। কারণ, চিকিত্সা না নিলে সমস্যাটি আরও বেড়ে যাওয়ার অশঙ্কা থেকে যায়।
সমস্যা: কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আসা একজন শিল্পী আমাকে অনুষ্ঠানের মঞ্চে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ‘কখনো কাউকে ভালোবাসার কথা বলেছো? যাকে ভালোবাসো তাকে ভালোবাসার কথা বলো।’ তখন আমি মঞ্চের সামনে গিয়ে ভালোবাসার মেয়েটিকে ভালোবাসার কথা বললাম। তার দুই দিন পর মেয়েটি জানিয়ে দেয়, সে আমাকে ভালোবাসে না। কিন্তু আমার সমস্যা হলো, সেই মেয়েটি ও আমি একই কলেজে লেখাপড়া করি। মেয়েটি ও তার বান্ধবীরা আমাকে নিয়ে কলেজে হাসাহাসি করে। তাই আমি নিয়মিত কলেজে যেতে পারছি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: তোমার বর্তমান মানসিক হয়রানি ও পড়ালেখার ক্ষতি শিকারের বিষয়টি সত্যিই দুঃখজনক। আমি মনে করি, এখানে শিল্পীর দিক থেকে যে আচরণ ঘটেছে তা কাঙ্ক্ষিত নয়। এভাবে তোমাকে জনসমক্ষে ভালোবাসার কথা বলতে বলাটা ঠিক হয়নি। শিল্পীদের কিন্তু সমাজের জন্য রোল-মডেলও হতে হবে। তবে তোমার দিক থেকেও একটি ভুল হয়েছে, এত মানুষের সামনে একটি স্বল্প পরিচিত মেয়েকে ভালোবাসা নিবেদন করাটা। ভালোবাসার সম্পর্কে অনেক গভীরতা থাকে এবং এটি একান্ত ব্যক্তিগত একটি অনুভূতি। একে এতটা হালকাভাবে না দেখলে খুব ভালো হয়। তা ছাড়া কাউকে ভালোভাবে না জেনে কী করে ভালোবাসা সম্ভব? কাউকে আমাদের দূর থেকে দেখে বা স্বল্প পরিচয়ের পর ভালো লাগতে পারে, কিন্তু অবশ্যই তা ভালোবাসা নয়। মেয়েটি নিশ্চয়ই সেই মুহূর্তে বেশ বিব্রতবোধ করেছে। পরবর্তীকালে তার বন্ধুরা ঘটনাটি নিয়ে মজা করছে কিন্তু বুঝতে পারছে না এতে তোমার কতটা কষ্ট হচ্ছে। সম্ভব হলে মেয়েটিকে সরাসরি বা কারও মাধ্যমে বলো, তুমি তোমার আচরণের জন্য লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। এ ধরনের ভুল ভবিষ্যতে তুমি আর করবে না, সেটি তার কাছে এবং নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করো, কেমন?
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১২, ২০০৯
Leave a Reply