নয় বছর পেরিয়ে দশে যখন পা ফেলেছিল প্রথম আলো, তখন লিখেছিলাম, ‘প্রথম আলো-ভালোবেসে যেখানে লিখি।’ এখন ১০ পেরিয়ে এল প্রথম আলো। এই দশমীতে প্রথম আলোর বিজয়মুকুট সূর্যরাগে ঝলমল। তবে ১০ বছরের এই পথচলা সবসময় সরল রেখায় হয়নি, বহু বাঁক, বহু দোলাচল শেষে এখন এই প্রথম আলো। অবশ্যই সব ভালোর সঙ্গে ছিল প্রথম আলো, আছে এবং থাকবেও। হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো যে প্রথম আলোর আবির্ভাব, সময়ের পলি পড়লেও এখনো তা উজ্জ্বল, পথিকজীবনে ‘সৃষ্টি তার চিরন্তন’। সৃষ্টিসুখের হাতিয়ার হিসেবে যে প্রথম আলোকে বেছে নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমান, তিনি এখনো প্রথম আলোকে পরিশ্রম সাধ্য বিচরণভূমি হিসেবে নিয়ে আছেন। নতুন নতুন ইচ্ছাকে ডানা মেলতে দেওয়ার এই প্যাশন তাঁকে নির্ভার হতে দেয়নি। সঙ্গে একঝাঁক তরুণ লিখিয়ে, কলম যাদের হাতিয়ার। অপ্রিয় হলেও স্পষ্ট কথা লিখতে যারা শিখেছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যাদের ধর্ম, বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করে যারা ধন্যবাদের পাত্র-তাদের সবাইকে নিয়েই সংসার। আছেন নবীন-প্রবীণ-সবাই। সব ভালোর সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই একে একে যোগ দিয়েছেন প্রথম আলোয়, আলোকের ঝরনাধারায় স্মাত হয়েছেন। তাঁদের সবার চোখে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন, আর স্বপ্নপূরণের ইচ্ছায় তাঁরা সহযাত্রী। ইতিমধ্যে প্রথম আলো অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে নিজগুণে, একটি পরিচ্ছন্ন, ্নার্ট ও ট্রেন্ডি পত্রিকা হিসেবে সব বয়সের লোকের প্রশংসাও অর্জন করেছে। আমরাও যারা প্রথম আলোর সূচনাকাল থেকে লিখছি, তারা লিখে লিখে জনগণের কাছাকাছি চলে এলাম। এ জন্য প্রথম আলোর কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সরলতা, সততা ও মুনশিয়ানার ছোঁয়া পেয়ে প্রথম আলো তিলে তিলে বড় হয়ে আজ তিলোত্তমা। এখন খুশিভরা দশম বর্ষপূর্তির গন্ধ তার অঙ্গে অঙ্গে।
ভালোবেসে এখানে লিখি। লিখতে লিখতে কতজনের সঙ্গে পরিচয় হলো, পাঠক-পাঠিকার ভালোবাসায় ধন্য হলাম। তাঁদের মনের কথা জানলাম, আমারও অনেক জানা হলো। এখানে লিখতে লিখতে স্বাস্থ্যের সীমানা পেরিয়ে সাহিত্যের জগতে ভীরু পায়ে প্রবেশ করেছি, স্বাস্থ্য-সাহিত্য দুটির মিশেলে লিখতে যে মজা, সে মজা আশ্চর্য হয়ে উপভোগ করেছি, সব কৃতিত্ব প্রথম আলোর।
এ তো আনন্দের অন্য এক ভুবনকে, তৃপ্তির একটি জগৎকে ছুঁয়ে ফেলার মতো ব্যাপার। তাই লিখে লিখে, পরামর্শ দিয়ে অন্য কারও উপকার যদি হয়, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে? আপনার লেখাটি পড়ে ভালো লাগল, বড় উপকার পেলাম-এসব কথা শোনার মতো আনন্দ আর কীসে আছে? আলোকিত মঞ্চে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তির হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করার চেয়েও বেশি আনন্দের ও তৃপ্তির।
স্বাস্থ্যকুশলে স্বাস্থ্যের প্রায় সব কথাই তো আছে। বেহাল, বিপর্যস্ত শরীরকে কী করে সামলানো যায়; আধুনিক জীবনের দুরন্ত গতিকে সামলে রেখে কীভাবে চাপমুক্ত থাকা যায়; সুস্থ, সতেজ, সুন্দর থাকা যায়··· ্লিপড্ ডিসক্ থেকে শুরু করে ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, ক্যান্সার, এইডস, হার্টের সমস্যা-কী নেই এতে? পেটব্যথা, গ্যাস, অম্বল, বুকজ্বলা, তরল মল, পরজীবী রোগ-এগুলোও তো আছে। লাইফ স্টাইলে কিছু অদলবদল করে, জীবন যাপনে কিছু সহৃদয় বোঝাপোড়া করে যে অনেক সংকট এড়ানো যায়, তা-ও তো বলা আছে। জীবনের মানবিক মুহূর্তগুলোর বর্ণনা, অসহায় রোগীর জবানিতে শকমালা, চিকিৎসা-দর্শনও তো এসেছে প্রথম আলোয়। আছে অস্ত-গোধূলিতে একা মানুষের জীবন নিয়ে লেখা, তার স্বাস্থ্য সমস্যা, শেষবিকেলে নারীর জীবনে স্বাস্থ্যসমস্যা। শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ, যুবক-যুবতী-বৃদ্ধ-সবারই স্বাস্থ্যসমস্যার অনুপুঙ্খ আলোচনা যাতে হয়, সেদিকে সজাগ নজর সম্পাদকের। আর পাতায় তার যত্নের ছাপ স্পষ্ট, যা অনেক পত্রিকায় দেখা যায় না। ফাস্টফুড, ভেজাল খাবার, ব্যায়াম, ধ্যানচর্চা, খাওয়া-দাওয়া-রকমারি সব বিষয়। বিশেষ দিনে বিশেষ প্রতিবেদন তো আছেই। প্রেগনেন্ট ও প্রিটি মহিলাদের শরীর ও মন কী করে ভালো রাখা যায়-এ নিয়েও আলোচনা। মেনোপজ ও হটফ্ল্যাশও বাদ যায় না। আছে মাদকের সর্বনাশা প্রভাব নিয়ে আলোচনা। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে প্রথম আলো পথিকৃৎ, সবাই জানে। এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রথম আলোর লড়াই যেদিন থেকে শুরু, সেদিন থেকে লড়াই চলছেই। স্টেমসেল থেকে শুরু করে জীনগত রোগ, এমনকি বৃহন্নলাদের শরীর-স্বাস্থ্য নিয়েও নিবন্ধ এসেছে।
আছে চিকিৎসাজগতে খ্যাতিমান সব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ। ভালোবাসার জ্নস্থান যে মন, এ নিয়েও আলোচনা কম হয়নি। আলোচনার গোলটেবিল প্রথম আলো যতগুলো করেছে, তা কম পত্রিকাই করেছে।
সব মিলিয়ে প্রথম আলো জনগণের মধ্যে ‘আর্ট অব ওয়েলনেস’-এমন একটি ধারণার জ্ন দিয়েছে। সামান্য ডায়েট, ব্যায়াম ও টাইম ম্যানেজমেন্ট জানলে অনেক ব্যারামের মধ্যে ‘আরাম অবিরাম’ পেতে পারি আমরা-এ কথা জানা গেছে প্রথম আলো পড়ে। আর স্বাস্থ্যসুখের সুলুকসন্ধান দিয়েছে প্রথম আলো অনেকটাই।
কিন্তু এত পাওয়ার পরও সন্তুষ্টি ও তৃপ্তির অবকাশ নেই।
ভালো হলে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে দায়িত্ব বেড়ে যায়। ফলভারে বৃক্ষ নত হয়, তাই প্রথম আলোর শুরু হবে বিনম্র পথচলা। আবিষ্কার ও সৃষ্টির আনন্দ, স্বপ্ন পূরণের অভিলাষ, বদলে দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড চেষ্টা-সব মিলে এই দিন থেকে প্রথম আলো নিরহঙ্কার মনে চলবে গন্তব্যের দিকে। আরও নতুন নতুন বিভাগ ও সংবাদ থাকবে এতে, সমাজের সত্য চেহারা ফুটে উঠবে এর পাতায়, আরও স্পষ্ট হয়ে, শুভ কর্মপথে প্রথম আলো পরিবারের নির্ভয় পদযাত্রা শুরু হবে। মানুষের মনের মধ্যে প্রথম আলোর জন্য যে ভালোবাসার জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, তা অটুট থাকবে- সমাজ বদলের হাতিয়ার হয়ে প্রথম আলো আবার আসবে নতুন রূপে, নতুন বারতা নিয়ে।
অধ্যাপক ডা· শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা।
সূত্রঃ প্রথম আলো, নভেম্বর ০৫, ২০০৮
Leave a Reply