প্রথম আলোর স্বাস্থ্যকুশল পাতা থেকে দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এবারও জোর অনুরোধ এসেছে কিছু লেখার জন্য। কলম ধরেছি তাই! কিন্তু ভাবছি রবিঠাকুরের কথাটি, ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। পেশায় আমি চিকিৎসক, তাই লেখায় মূলত আসবে স্বাস্থ্য আর চিকিৎসা সম্পর্কিত কথকতা। কিন্তু চিকিৎসক হলেন সমাজের ডাইনামিক ইন্টার্যাকশনের একটি অংশীদার। তাই সমাজ সম্পর্ক আর তার সমস্যার কথাই বা কেন বলবেন না? প্রেক্ষিত না হয় কমলো, চিকিৎসক আর রোগীদের ‘লাভ-হেইট-রিলেশনশিপ’।
গল্প শুনি বিধান রায়ের কথা, নন্দী ডাক্তারের কথা, অধ্যাপক জি এম চৌধুরীর কথা। তাঁরা কিন্তু লিজেন্ড হয়েছেন চিকিৎসা দক্ষতার জন্য শুধু নয়, তাঁদের মানবিক গুণাবলির জন্যও। এই বারডেমের অধ্যাপক ইব্রাহিম যেমন বলতেন, ‘সেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
এই সেন্টিমেন্ট আর এই চিকিৎসকেরা কি আজ আর নেই? অবশ্যই আছেন। সারা দেশে অসংখ্য চিকিৎসক এ রকম অ্যাটিচুড নিয়ে কাজ করে বেড়াচ্ছেন, প্রচারের মুখ না চেয়ে। আর সুকাজের বর্ণনার বাজার কাটতি কম, সেনসেশনাল রঙডুয়িং চলে ভালো। এটা হলো বাস্তবতা। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে যে ইন্টার্নি চিকিৎসকেরা আছেন, তাঁদের কাছে রোগীর জন্য নিজের রক্ত দান করা ডালভাত। এ নিয়ে তারা বড়াইও করেন না। রবিনহুডের মতো সামর্থ্যবান রোগীদের ওষুধপত্র বাঁচিয়ে, পথের ফকিরের অপারেশন করে দেওয়ায় তাঁরা কোনো ভুল দেখেন না, দায়িত্ব মনে করেন। নিজের এলাকায় গিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাম্প করা বা হাসপাতাল স্থাপন করা অনেক বিশেষজ্ঞেরই স্বপ্ন এবং অনেকের কাছে সহজ বাস্তবতা। তাহলে সমস্যাটি কোথায়?
আমি বলি, সমস্যা হলো, কমিউনিকেশনে আর অ্যাটিচুডে। অপারেশনের জন্য রোগী বসে আছে ক্লান্তিকর অপেক্ষায়। তাকে দুটি কথা বলি-কেন দেরি হচ্ছে, তাহলে কিন্তু সেই রোগীই হাসিমুখে বলবে, ‘বেশ অসুবিধা নেই ডাক্তার সাহেব, আমি অপেক্ষা করছি।’ জটিল অথবা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন তৈরি হলো কোনো রোগীর, তখন কোল্ড কেস অর্থাৎ খুব খারাপ নয় যেসব রোগী, তাদের জানিয়ে দিই যে দেরি হচ্ছে কী কারণে, রোগীরা কিন্তু বিরক্ত হলেও সেটা গ্রহণ করে নেয়। মুশকিল হলো অন্যখানে। যখন অন্য রোগীরা দেখে, অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের রোগী লাইন বাইপাস করে সরাসরি কাজটি হাসিল করে গটগটিয়ে চলে যাচ্ছে-তখনই বিক্ষুব্ধ হয় মন, উচ্চকিত হয় কণ্ঠ, আর চিকিৎসকের সুনাম হয় নষ্ট। কিন্তু আমাদের চিকিৎসকেরা তো এ সমাজেরই অংশ। এই ‘অমুক-তমুক ভাই আর স্যার’দের গোড়ায় পানি না দিলে চিকিৎসকও পড়ে যান বিপদে। তাই প্রায়ই ঘোরতর অনিচ্ছা থাকলেও তিনি হাসিমুখে বলতে বাধ্য হন, ‘আরে আসেন অমুক ভাই, কী সৌভাগ্য আমার! বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি!’
সাফাই গাইছি? তা-ই গাইছি বটে, কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকারও তো করতে পারি না! আমার আপত্তি হলো সেই চিকিৎসকদের নিয়ে, যাঁরা ভুলে যান শব্দ এবং বাক্যবিন্যাসের মুখের কথা কত পার্থক্য তৈরি করতে পারে। ধরুন, একটি করোনারি কেয়ার ইউনিটে রোগীর অ্যাটেনড্যান্টস ও আত্মীয়স্বজন ভিড় করে আছে। বিশেষজ্ঞ এসেছেন রোগী দেখতে, কিন্তু পরিবেশটি হলো বাজারের মতো। ওয়ার্ড বয় তখন চেঁচায়, ‘এই আপনারা বের হোন, বের হোন! স্যার রোগী দেখবেন।’ মনটা চটে যায়! আমি কি পথের কুকুর যে আমাকে অমন করে বের হতে বলছে! এবার আমি বাক্যটি বদলে দিই। সেই ওয়ার্ড বয় যদি চেঁচাত ‘প্লিজ, আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন। স্যার রোগী দেখবেন।’ তাহলে কিন্তু সবাই সহজভাবে বাইরে গিয়ে রোগী দেখার পরিবেশ করে দিত চট করে। ‘কথা’র যে এই ক্ষমতা, সেটি কিন্তু আমাদের মেডিকেল সিলেবাসে কখনো ব্যাখ্যা করা হয় না। খারাপ রোগীর সামনেই তাই আমাদের বিশেষজ্ঞরা দিব্যি বলে বসেন, ‘এ তো বাঁচবে না!’ সেই আধমরা রোগীর যদি সামান্যও বাঁচার আশা থাকত, সেটি এক ফুঁৎকারে উবে যায়। সেই প্রাচীন কথা, ‘সত্যম ব্রুয়াৎ, প্রিয়ম ব্রুয়াৎ, ন ব্রুয়াৎ, সত্যম অপ্রিয়ম।’ সত্য বলব, প্রিয় কথা বলব। সত্য কিন্তু অপ্রিয় কথাটি চট করে সরাসরি না বলাই এখানে উত্তম। এই খারাপ সংবাদটি রোগীকে কিংবা তার আত্মীয়স্বজনকে কীভাবে দেওয়া যায় সেটি কিন্তু শেখার বিষয়। বিদেশে মেডিকেল কারিকুলামে এ নিয়ে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমাদের ঠিক এমনটি নেই।
চিকিৎসকের মুখের কথার কত যে মূল্য, সেটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দেখলে বোঝা যায়। রোগীরা তাঁর কথাতেই অর্ধেক ভালো হয়ে যেত, আর বাকি অর্ধেক তাঁর চিকিৎসায়। তাই চিকিৎসাক্ষেত্রে মিষ্টিমুখের আসলেই কোনো তুলনা নেই। কিন্তু এর জন্য দুইপক্ষেরই দায়িত্ব আছে। জোর খাটিয়ে, ক্ষমতা দেখিয়ে, অর্থ দিয়ে চিকিৎসা কিনে নিতে চায় কিছু রোগী। আমি তাদের বলি, এত দাম্বিভকতার আসল মূল্য কতটুকু! জ্নেছি মাইক্রোস্কোপিক শুক্রাণু হয়ে, জীবিত অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছি মলমূত্র পেটের মধ্যে নিয়ে, আর মারা গেলে হব কীটের খাদ্য গলিত মৃতদেহ। কাজেই চিকিৎসক ও অন্যান্য রোগীকে সম্মান দিতে কার্পণ্য করা ঠিক নয়। মিস কমিউনিকেশনের কথা যখন ওঠে, আমি তখন দেখি রোগীর কথা আর চিকিৎসকের উপলব্ধি-এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু। আমার ছাত্রদের আমি সব সময় বলি, ‘তোমাদের উচিত, গল্পের বই, উপন্যাসের বই আর কবিতার বই পড়া। এতে তোমাদের ইমাজিনেশন বাড়বে। রোগীরা সবাই আর্টিকুলেট নন। তাঁদের কষ্ট-বেদনা সবটুকু তাঁরা প্রকাশ করতে না পারলেও চিকিৎসক তাঁর ইমাজিনেশন দিয়ে, তাঁর হৃদয় দিয়ে সেটি অনেকখানি বুঝে নেওয়া উচিত।’ তাহলেই চিকিৎসা কর্মটি সুচারু হবে। আমার দৃষ্টিতে মেডিকেল কারিকুলামে সাহিত্য আর লজিক-এই দুটি বিষয়ে কিছু পড়ানো হলে বেশ ভালো হতো। আমাদের কথকতাও হতো সুচারু, আর দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারাও হতো লজিক্যাল।
আসলে শিক্ষার কথা যখন উঠলই, তখন আমার একটি ক্ষোভের কথা প্রকাশ করে ফেলি। আজকাল তদবিরবিহীন ভালো ছেলেদের পরীক্ষার ফল খুব ভালো করা বেশ কঠিন।
প্রখ্যাত-বিখ্যাত-প্রভাবশালী মা-বাবার ছেলেমেয়েরা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও পোস্টগ্র্যাজুয়েট এই দুই মেডিকেল সেকশন লেভেলেই সত্যিকারের মেধাবী ছেলেমেয়েকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের সেই ‘স্যার’রা সরকারি মেডিকেল কলেজে ‘অনার্স মার্কস’ দিতে ভুরু কুঁচকে ফেলতেন, অবসরের পর প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সেটি দেওয়ার জন্য তাঁরা অনেক সময় ঝুলোঝুলি করেন। এটি ঘোরতর অন্যায়। আজকাল পরীক্ষা হলে পলিটিক্যাল টেলিফোন ও লিস্টি আমাদের সব মেডিকেল এডুকেশনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। সব সমাজের অবক্ষয় এখানেও প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু এতে দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় যে কী ঘোরতর সুদৃঢ়প্রসারী ক্ষতি হয়ে গেল, সেটি কি আমাদের বিবেকে ক্ষত সৃষ্টি করে না?
এমনিতেই এখন এনবিআরের সিদ্ধান্তমতে চিকিৎসা হলো পণ্য। ভ্যাটের আওতাভুক্ত। কাজেই সব মিলিয়ে চিকিৎসক যে রোগীদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক রাখবেন, সেটি কিন্তু কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
কমিউনিকেশন গ্যাপে রোগীদেরও কিন্তু অংশীদারি আছে। প্রায়ই দেখি, একই রোগীর জন্য পাঁচজন অ্যাটেনড্যান্ট বিভিন্ন সময়ে এসে কথা বলছেন। অথচ বেশির ভাগ সময়েই তাঁরা রোগীর অ্যাকচুয়াল দায়িত্বসম্পন্ন অভিভাবক নন। বিষয়টি এমন যে রোগীর স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বাবা, ভাই, শ্বশুর যে অভিভাবকত্বের দাবি রাখেন; রোগীর চাচাতো শ্বশুর বা মামাতো ভাই বা বন্ধু সেই অভিভাবকত্বের দাবিদার নন। কাজেই তাঁরা যখন বিভিন্ন সময়ে একই রোগীর বিষয়ে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞের কাছে রোগীর অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ করতে চান, তখন বিষয়টি সময় অপচয়কারী সংলাপ হয় মাত্র, কাজের কাজ হয় না। প্রায়ই তাঁরা দাবি করেন, ‘ডাক্তার সাহেব, রোগীর জন্য স্পেশাল কেয়ার করবেন, অনেক ছাড় দেবেন, সব দায়িত্ব নেবেন ইত্যাদি।’ এটা তো হাস্যকর কথা। এসব সহানুভূতি দেখানো লোকদের জন্য আমার সহজ বক্তব্য হচ্ছে, রোগীর জন্য আপনার যদি মায়া-মমতা থাকে, তবে রোগীর অভিভাবকের কাছে কিছু অর্থ সাহায্য দিয়ে যান। তাতে বিশেষত্ব ক্রিটিক্যাল রোগীদের, যাদের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল, তাদের বিশেষ উপকার হবে। চিকিৎসক তাঁর নিজের পাওনা দান করে দিয়ে রোগীর চিকিৎসা করতে থাকবেন-এই আশাটুকু করার আগে নিজে দানশীল হওয়া উচিত। ক্রিটিক্যাল রোগীর ক্ষেত্রে ফ্যামিলির পক্ষ থেকে একজন স্পোক পারসন থাকা উচিত, যে সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলবে বা সিদ্ধান্তের অংশীদার হবে। তাহলে রোগীর চিকিৎসা সহজতর হয়।
সবশেষে একটা কথা বলি। আমাদের (বিশেষজ্ঞদের/চিকিৎসকদের) একটা সহজ সত্য মনে রাখা উচিত। আমরা রোগীদের সব কষ্ট বা সব সিম্পটমের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারব না। কিছু জিনিস হয়তো এখন অব্যাখ্যাত; কিন্তু ভবিষ্যতে সেটির ব্যাখ্যা আসবে নিশ্চিতভাবেই। কাজেই ‘আমি জানি না’ বা ‘আমি বুঝতে পারছি না’-এ কথাটি বলার মধ্যে আমি কোনো গ্লানি দেখি না; সত্যের সহজ ঋজুতা দেখি। যদি প্রয়োজন হয় আমাদের উচিত এই সমস্যার সমাধানের জন্য উপযুক্ত অন্য বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো। কিন্তু সেটি না করে ‘বুঝ দেওয়া’ ব্যাখ্যায় রোগীর মন ভরানোর চেষ্টা করা উচিত নয়। রোগীদেরও কিন্তু সেটি মনে রাখা ভালো। সবকিছুরই আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। সব সিম্পটমের আলাদা আলাদা করে ফর্দমাফিক চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। প্রায়ই মূল রোগের চিকিৎসায় সেই শাখা-প্রশাখা সিম্পটমগুলোও ভালো হয়ে যায়। সে জন্য দরকার চিকিৎসা শুরু করে সবুর করা (অবশ্যই রিজনেবল সময় পর্যন্ত, অনাদিকালের জন্য নয়)। এটি না করে বারবার চিকিৎসক বদলানো (আমি বলি কেবলা বদলানো) কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ কথার কচকচি করলাম এজন্য যে সংলাপ সংঘর্ষকে এড়ানোর সর্বোত্তম পদ্ধতি, এটি আমার বিশ্বাস। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো (এভরি অ্যাকশন হ্যাজ অপজিট অ্যান্ড ইকুয়্যাল রিঅ্যায়েকশন) চিকিৎসক-রোগীর সম্পর্কও চাওয়া-পাওয়ার দ্যোতনায় দুলবে। দুজনের মধ্যে সম্পর্কটি অল্প কিছু চিকিৎসকের বা রোগীর রূঢ় ব্যবহারের জন্য নষ্ট হবে-এমনটি আমি, আপনি সবাই মিলে প্রতিরোধ করা উচিত। মানবিক সম্পর্কের মৌলিক দিকগুলো আমাদের সবার মধ্যে প্রতিফলিত হলে সেটি অবশ্যই সম্ভব। শুভেচ্ছা সবাইকে।
ডা· আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী,
সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্রঃ প্রথম আলো, নভেম্বর ০৫, ২০০৮
Leave a Reply