সমস্যা: দুই হাতে ঠেলছি স্রোত, অনির্দিষ্টের পথ—জানি না, কোথায় পাবে কূল এই ছিন্নভিন্ন দেহ, এই ভাঙাচোরা মন। আমি মোটামুটি একটি সম্মানজনক পেশায় নিয়োজিত একজন নারী। তার পরও হতাশা, হীনম্মন্যতা, বিষণ্নতা আমার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু বরাবর আমি এ রকম ছিলাম না। ‘বিয়ে’ নামের বিষয়টিই আমূল পাল্টে দিল এই আমাকে। পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছিল ২০০৬ সালে। তারপর পারিবারিকভাবেই বিচ্ছেদ। বন্ধুদের সুখী সংসার দেখে কষ্ট হয়—এ রকম একটা জীবন তো আমারও হতে পারত।
কর্মস্থলে সহকর্মীদের বিরূপ মন্তব্যে অপদস্থ হই প্রতিনিয়ত। কিছু দিন আগে (খুব কাছের!) এক বন্ধুর বিয়ে হলো। বিয়ের পর তার আমূল পরিবর্তন। কেননা তার স্বামী আমার মতো মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ পছন্দ করেন না। (অথচ আমার সঙ্গে তার এক দিন ফোনে কথা না হওয়া মানে ছিল আশ্চর্যজনক ঘটনা)। কিন্তু কাউকে বোঝানোর উপায় নেই, বিয়ের নামে কতটা প্রতারিত হয়েছি আমি। এখন মাঝে মধ্যে পরিবারের লোকজনকেও অসহ্য বোধ হয়। রাতের পর রাত কাটে নির্ঘুম। মনে হয়, আত্মহত্যা মানেই মুক্তি। কিন্তু আমি পুরোনো সব ঝেড়ে-মুছে আগের আত্মপ্রত্যয়টা ফিরে পেতে চাই।
নিলয়
পরামর্শ: আমাদের সমাজে মেয়েদের বিচ্ছেদ হলে সবটুকু দায় মেয়েটিরই বহন করতে হয়। তাকে দোষারোপ করা হয় এই বলে যে, সে কেন আরও মানিয়ে চলার চেষ্টা করল না। সামাজিকভাবেও তাদের তখন গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। সেই তুলনায় ছেলেটিকে তেমন দায়ভার বহন করতে হয় না। সমাজের এই মনোভাব পরিবর্তনের জন্য কিন্তু মেয়েদেরই আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। হীনম্মন্যতা ঝেড়ে ফেলে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে জীবনকে দেখার প্রয়াস চালাতে হবে। তুমি একটি সম্মানজনক পেশায় রয়েছ—এটি তো এ সমাজের একজন মেয়ের জন্য অত্যন্ত প্রশংসার দাবি রাখে। তোমার বিয়েটা খুব স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল, তা বোঝা যাচ্ছে। যদি কোনো সন্তান না থাকে, তাহলে তো তুমি নিজের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা করতে পারো নিজের মতো করে, তাই না? অন্য বন্ধুদের সঙ্গে নিজের পরিস্থিতির তুলনা করলে কষ্ট আরও বাড়বে। সে কারণে বর্তমানে তোমার জীবনে যেসব ইতিবাচক দিক রয়েছে, সেই ভাবনাগুলোকে বেশি প্রাধান্য দাও। খুব কাছের বন্ধুর কাছে যে কষ্ট পেয়েছ, তা সত্যিই পীড়াদায়ক। হয়তো বা বর্তমানে সে তার স্বামীর ইচ্ছেকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। যদি তোমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে সত্যিই আন্তরিকতা ও সততা থাকে, তাহলে কখনো নিশ্চয়ই আবার তোমার সঙ্গে আগের মতো আচরণ করবে। আত্মহত্যা কখনোই মুক্তি হতে পারে না। তুমি তো একজন প্রতারকের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছ। স্বামীটি এখনো তোমার জীবনে থাকলে তোমার জীবনটা তো দুর্বিষহ হয়ে পড়ত। তাই আমার অনুরোধ থাকবে, সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের ভেতর দিয়ে নিজেকে সার্থক ও সফল করে তোল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে, নিজেকে শ্রদ্ধা করে আর ভালোবেসে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখো। নিন্দুকেরা কথা বলবেই, কিন্তু তোমার যে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার পরিপূর্ণ অধিকার আছে, এটা কখনো ভুলে যেও না। যা ঘটে গেছে, তার জন্য নিজেকে একটুও দোষারোপ না করে ভবিষ্যতে অন্য মেয়েদের মধ্যেও আত্মবিশ্বাস তৈরি করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হও।
সমস্যা: আমি প্রায় দেড় বছর ধরে একটি মেয়েকে পছন্দ করি। মেয়েটিকে এত ভালোবাসি যে, তাকে আমার পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিদিন মেয়েটির পেছনে পেছনে ঘুরি তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, কিন্তু মেয়েটির পেছনে ঘোরায় সে তার বাবাকে বলে দেয়। পরে তার বাবা আমাকে ভীষণ অপমান করে। এতে আমি খুবই কষ্ট পাই। মেয়েটি আমার ভালোবাসা বুঝতে চেষ্টা করছে না। আমি কয়েক মাস আগে তাকে সাহস করে বলে ফেলি যে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’। উত্তরে সে ‘না’ বলে দেয় এবং আবারও বাড়িতে বলে দেওয়ার হুমকি দেয়। এখন আমি বুঝে উঠতে পারছি না, কী করব।
রাইসুল
নীলফামারী
পরামর্শ: তুমি দেড় বছর ধরে চেষ্টা করেও মেয়েটির কাছ থেকে সাড়া পাওনি। যদি তোমার মনে হয়ে থাকে, তুমি সারা জীবন তার অপেক্ষায় থাকবে, তাহলে তো কিছু করার নেই। তবে শুধু আবেগে তাড়িত না হয়ে তুমি যদি যুক্তির দিকটি এখন ব্যবহার করো, তাহলে খুব ভালো হয়। তোমার যেমন ওকে ভালোবাসার অধিকার আছে, মেয়েটিও কিন্তু সমপরিমাণ অধিকার রাখে তোমাকে সেভাবে ভালো না বাসার। তুমি যদি ওকে সেই অধিকারটুকু না দিয়ে ওর ওপর জোর খাটাও, তাহলে তোমাকেই কষ্ট পেতে হবে দিনের পর দিন। এতে তোমার আত্মমর্যাদাবোধও ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভীষণভাবে। ওর বাবা এবং পরিবারের লোকজন যদি তোমাকে বারবার অপমান করে ও হুমকি দেয়, তাহলে তুমি এর জন্য তোমার সত্তাকে অবমূল্যায়ন করতে থাকবে। এখন তোমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে পড়ালেখায় মনোযোগী হয়ে নিজের ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করা। ছাত্রজীবনে এত দিন ধরে একটি মেয়ের পেছনে এভাবে সময় নষ্ট করলে কিন্তু পরবর্তী সময়ে তুমিই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বে।
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৪, ২০০৯
Leave a Reply