অ্যানেসথেসিয়া বা অবেদন-প্রক্রিয়া এমন একটি পদ্ধতি, যা অস্ত্রোপচারের সময় ব্যবহার করা হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে দাঁত তোলা থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের মতো ছোট-বড় কয়েক লাখ অস্ত্রোপচার হয়।
মানুষের ভয়ভীতি অজানা জিনিসের প্রতি থাকেই। আপনার অস্ত্রোপচার বা অপারেশন হবে। এ জন্য আপনাকে অ্যানেসথেসিয়া বা অবেদনিক ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে অজ্ঞান করা হবে-এটা শুনে অনেকেই ভীত হয়ে পড়েন। বর্তমানে আরও নিরাপদ অবেদনিক ওষুধ আবিষ্কারের ফলে এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও আধুনিক অস্ত্রোপচারের অগ্রগতি হওয়ায় অস্ত্রোপচারের জন্য অ্যানেসথেসিয়ার ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক অনেক নিরাপদ হয়েছে।
অ্যানেসথেসিয়ার প্রকারভেদ
অস্ত্রোপচারের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেসব পদ্ধতিতে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয় তা হলো-
পুরোপুরি অজ্ঞান করা (জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া)
সাধারণত বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে রোগীকে পুরোপুরি অজ্ঞান করার প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত শিরাপথে অ্যানেসথেসিয়ার ওষুধ প্রয়োগ ও মুখোশের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্যাস, যেমন অক্সিজেন, নাইট্রাস অক্সাইড, হ্যালোথেন (উদ্বায়ী পদার্থ) ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে পুরো অস্ত্রোপচারের সময় অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়।
অস্ত্রোপচার শেষ হলে অবেদনবিদ অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগকারী ওষুধের বিপরীত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোগীর হুঁশ ফিরিয়ে আনেন। সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এলে অবেদনবিদ ও সেবিকারা রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখেন। পরে রোগীকে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।
অংশবিশেষ অবশ করা (রিজিওনাল অ্যানেসথেসিয়া)
এই পদ্ধতিতে শরীরের কোনো বড় অংশ বা অংশবিশেষ অনুভূতিহীন বা অবশ করা হয় এবং অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়। অবেদনকারী ওষুধ একটি স্মায়ু কিংবা প্রয়োজনে একগুচ্ছ স্মায়ুর চারপাশে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত ঊর্ধ্ববাহুর অস্ত্রোপচারে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। দেহের নি্নাংশ অবশ বা অনুভূতিহীন করার জন্য মেরুদণ্ডের স্মায়ুতে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। এ অবস্থায় শিরাপথে ওষুধের প্রয়োগের ফলে রোগীকে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে রোগীর হুঁশ ঠিকই থাকবে। নি্নবাহু, শ্রেণী (পেলভিস) বা নিতম্বের অস্ত্রোপচার এবং সিজারিয়ান অপারেশনে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সামান্য অংশ অবশ (লোকাল অ্যানেসথেসিয়া)
এ পদ্ধতিতে শরীরের সামান্য একটু অংশ অবশ বা অনুভূতিহীন করে রাখা হয় এবং রোগী পুরোপুরি সচেতন থাকে। ছোটখাটো অস্ত্রোপচার, যেমন-দাঁতের চিকিৎসা, ত্বকের কলাচ্ছেদন (বায়োপসি), সামান্য কেটে গেলে তা সেলাই প্রভৃতির প্রয়োজনে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
এ ধরনের ছোটখাটো অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত ওষুধের ক্রিয়া স্বল্পস্থায়ী আর এর প্রয়োগও ভিন্ন ধরনের। স্প্রে, মলম ও ইনজেকশনের মাধ্যমে এসব অবেদনিক ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।
অস্ত্রোপচার-পূর্ববর্তী শর্ত
যেকোনো অস্ত্রোপচারের আগে অবেদনবিদ বেশ কিছু বিষয়ে রোগীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। ফলে যথাযথ অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। অবেদনবিদের সঙ্গে রোগীর যেসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, তা এখানে উল্লেখ করা হলো।
বর্তমান ক্লিনিক্যাল বা নিদানিক অবস্থা
রোগীর বর্তমান শারীরিক অবস্থা, বিশেষ করে ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, বৃক্ক বা প্রস্রাবে কোনো সমস্যা থাকলে অবেদনবিদ এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবেন।
ওষুধের ব্যবহার
রোগী বর্তমানে কী ওষুধ খাচ্ছে, কত দিন ধরে খাচ্ছে, কী রোগের জন্য খাচ্ছে-এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য অবেদনবিদ জেনে নেবেন। কারণ অবেদনিক ওষুধের সঙ্গে অনেক ওষুধের মিথস্ক্রিয়া হতে পারে।
ওষুধ বা কোনো খাবারে অ্যালার্জি
আপনার বিশেষ কোনো খাবার বা ওষুধের প্রতি অ্যালার্জি থাকলে অবশ্যই তা অবেদনবিদকে জানাতে হবে। এ ব্যাপারে অবেদনবিদ প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করবেন।
ধূমপায়ী বা মদ্যপায়ী
ধূপমান বা মদ্যপান অ্যানেসথেসিয়ার ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। এ জন্য রোগীর উচিত অবেদনবিদকে এ ব্যাপারে জানানো। এতে তিনি পরিমাণমতো ও প্রয়োজনমতো অবেদনিক ওষুধ প্রয়োগ করবেন। ফলে রোগী নিরাপদ থাকবেন।
আগে হওয়া অস্ত্রোপচারকালীন সমস্যা
রোগীর আগে অস্ত্রোপচার হয়ে থাকলে এবং অস্ত্রোপচারকালে কোনো সমস্যা হয়ে থাকলে তা অবশ্যই অস্ত্রোপচারের আগে অবেদনবিশেষজ্ঞকে জানাতে হবে। এখন আধুনিক উন্নত অস্ত্রোপচারের কৌশল এবং নির্দিষ্ট অবেদনিক ওষুধ প্রয়োগের ফলে অস্ত্রোপচারের সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ওষুধের মিথস্ক্রিয়া এড়ানো সম্ভব।
অস্ত্রোপচারকালীন পর্যবেক্ষণ
অস্ত্রোপচারের সময় রোগী নিঃশ্বাস নিচ্ছে কি না তা সারাক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণের পাশাপাশি হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা, দেহের তরল পদার্থের ভারসাম্য এবং রক্তে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ইত্যাদিও পর্যবেক্ষণ করা হয়। নির্দিষ্ট মাপের বাইরে উল্লিখিত নির্ণয়কগুলো গেলে অ্যালার্ম বা বিপদঘণ্টা বাজবে। তখন বিশেষজ্ঞ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এ জন্য অস্ত্রোপচারকালে সঠিক পর্যবেক্ষণ-ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যানেসথেসিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া
জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ায় অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হলে অবেদনিক ওষুধের বিপরীতক্রিয়া চালু করা হয়। সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এলে রোগীকে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী কক্ষে নেওয়া হয়। সেখানে রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ব্যথা সারানোর ওষুধ দেওয়া হয়। কারণ, দীর্ঘস্থায়ী তীব্র ব্যথা রোগীর শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে।
অ্যানেসথেসিয়া প্রক্রিয়া পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা একেকজনের একেক রকম। তবে এখন নতুন কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত অ্যানেসথেসিয়া মেশিন বা ভেন্টিলেটরের ব্যবহার এবং অত্যাধুনিক পর্যবেক্ষণ মেশিন ব্যবহার করায় অ্যানেসথেসিয়া আজ যথেষ্ট নিরাপদ। তাই কারও অ্যানেসথেসিয়া-ভীতি থাকলে তা দূর করুন আজই।
ডা· রেজাউল ইসলাম
অ্যানেসথেসিওলজি বিশেষজ্ঞ
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৯, ২০০৮
Leave a Reply