শিশুদের সৌন্দর্য চিরন্তন। আজকের কুঁড়িরাই আগামীর প্রস্ফুটিত ফুল। এরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তাই তাদের সুস্থ, সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠা একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু শিশুরা নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে ভোগে। বিভিন্ন রোগের মধ্যে বর্তমানে হ্নদরোগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। হার্টকে সুস্থ রাখার জন্য শৈশব থেকে সচেষ্ট হতে হবে। কারণ ছেলেবেলা হতে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন প্রণালী মেনে চললে সারাজীবন এই অভ্যাসগুলো মেনে চলার প্রবণতা থাকে। এজন্য কিভাবে হার্টকে সুস্থ রাখা যায়, কোন্ জীবন প্রণালী মেনে চললে হার্ট ভালো থাকবে সে শিক্ষা ছোটকাল থেকেই দিতে হবে।
ছেলে-মেয়েদের প্রতিদিন ব্যায়াম করতে বলুন। দিনে অন্ততপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করা প্রয়োজন। ব্যায়ামের উপকারিতা সম্পর্কে বোঝান। স্কুলের পিটি, প্যারেড যেন ভালোভাবে করে সে সম্পর্কে শিক্ষা দিন। স্কুল থেকে ফেরার পর পরই বাচ্চাকে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসাবেন না। তাদের কিছু সময় দিন। মনে রাখতে হবে দিনের একটা সিংহভাগ সময়ই বাচ্চারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সময় কাটায়; যেখানে বসে থাকতে হয়। সুতরাং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সময় শেষে তাদের শারীরিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। স্কুলের পরে এবং রাতে খাবারের আগে বাচ্চাদের অবশ্যই শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা উচিত।
আপনার সন্তানদের শারীরিক পরিশ্রম করতে উদ্বুদ্ধ করুন। বাচ্চার সবকিছু করে দিতে হবে এই মানসিকতার বদলে তাকে নিজে নিজে শিখতে দিন। কাজকর্ম করার ফলে তার কায়িক পরিশ্রমের সুযোগ হবে। সংসারের কিছু টুকিটাকি কাজ করার সাথে বাচ্চাকে অভ্যস্ত করুন। এতে তার মনোবল দৃঢ় হবে, আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং শারীরিক পরিশ্রমও বাড়বে।
টেলিভিশন, সিনেমা, ভিডিও কিংবা কম্পিউটার গেমসের পেছনে সব মিলে দিনে দুই ঘন্টার কম সময় ব্যয় করতে দিন। বাকি সময় শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকতে বলুন। আমরা এখন শিশুদের টিভির সামনে বসিয়ে রাখতে পছন্দ করি। একটু বিরক্ত করলেই কার্টুন চ্যানেল বা অন্যান্য চ্যানেল খুলে দেই। খাওয়ানোর সময় টিভি দেখানো একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শৈশব থেকেই তারা এই খারাপ অভ্যাসটাতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে এটা কিন্তু তারা চিনতো না, বাবা-মাই তাকে এমনটা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
আমরা জানি পায়ে হেঁটে চলা সবচেয়ে নিরাপদ। গাড়িতে চড়ার চেয়ে স্বল্প দূরত্বে পায়ে হেঁটে আপনি এবং আপনার সন্তান চলুন। লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। সুযোগ থাকলে সাইকেলে করে বাচ্চাকে স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।
ফুটবল, টেনিস, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলাধুলা করতে দিন। সম্ভব হলে এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করে দিন।
শিশুরা স্বভাবতই চঞ্চল হয়। তারা খেলতে, দৌড়াতে পছন্দ করে। কিন্তু আমাদের বিধি-নিষেধের ফলে তারা ধীরে ধীরে স্বভাবজাত অভ্যাসগুলো হারায়ে ফেলে। যার দরুন অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হয়, এই সকল দিকে আমাদের নজর দেয়া উচিত।
এটা সত্যি যে বর্তমানে আমাদের বাচ্চাদের খেলাধুলার সুযোগ অনেক কম। সমাজের সকলকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ছেলে-মেয়েকে যতদূর সম্ভব খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে।
সন্তানকে উপহার হিসেবে অন্যান্য উপহারের সাথে ফিটনেসের সাথে সম্পর্কিত সামগ্রী, যেমন-দড়ি খেলার জন্য দড়ি, টেনিস বল, র্যাকেট, ব্যাট, ফুটবল এসব দিন। তাদের মনে এসবের প্রতি আগ্রহ জাগাতে হবে।
ছোট বাচ্চাদের সবসময় কোলে না রেখে নামিয়ে দিন। এতে সে হাত-পা নাড়বে এবং খেলতে পারবে যাতে ব্যায়াম হবে।
বাচ্চার স্কুল বেশি দিন ছুটি থাকলে পরিবারের সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার চেষ্টা করুন এবং সে সময় বিভিন্ন খেলাধূলার সুযোগ করে দিন। যেমন- দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, ফুটবল খেলা, পাহাড় বেয়ে ওঠা, সাঁতার কাটা ইত্যাদি। তবে অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে কোন দুর্ঘটনা না ঘটে।
স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে উৎসাহিত করুন।
স্কুলে যাওয়া বাচ্চাদের নাস্তা অথবা দুপুরের খাবার হিসেবে ফলমূল এবং শাক-সবজি দিন। বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় সালাদ দিন।
টেবিলে কখনো লবণদানি রাখবেন না। তাতে বাচ্চার পাতে লবণ খাওয়ার অভ্যাস হবে না।
চকলেট, স্ন্যাক্স, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়ের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে তুলে ধরবেন এবং এসব খাওয়া থেকে বাচ্চাদের বিরত রাখবেন।
চকলেট, আইসক্রীম এ সকল গিফটের পরিবর্তে ফলমূল দিন। আমাদের দেশে এখন প্রায়ই শোনা যায় বাচ্চা মাংস ছাড়া কিছুই খায় না। কিন্তু মনে রাখবেন আপনি যা শেখাবেন বাচ্চা তাই শিখবে। আদর করতে গিয়ে ভবিষ্যতে আপনার সন্তানকে হ্নদরোগ ঝুঁকির দিকে এগিয়ে দিবেন। ছোটবেলা থেকেই মাছ খেতে উৎসাহিত করুন। মাছ, মাংস, সবজি, ডাল, ফলমূল অর্থাৎ সব ধরনের খাবারই খেতে দিন। পুষ্টিকর সুষম খাবার খাওয়াতে অভ্যস্ত করুন।
বাড়ির পরিবেশ ধূমপানমুক্ত রাখুন এবং ছেলে-মেয়ে যাতে ধূমপান থেকে দূরে থাকে সে ব্যাপারে সজাগ হন। বাবা-মা ধূমপান করলে তার ধোঁয়ায় সন্তানেরও ক্ষতি হয়। মাদকদ্রব্য বা যে কোন নেশা জাতীয় দ্রব্যের কুফলতা সম্পর্কে সন্তানকে সম্যক ধারণা দিন। ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কে শিক্ষা দিন।
খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে মনে রাখতে হবে আপনার সন্তানের অধিক পুষ্টির দরকার। কিন্তু তাদের পাকস্থলী ছোট, তাই এমন খাবার খাওয়াতে হবে যেন তারা পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়। আবার অধিক খাবার খাওয়ানো উচিত না।
বাচ্চাকে আঁশ জাতীয় খাবার, রুটি, সিরিয়াল, তাজা শাক-সবজি, কম ননীযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য, কম চর্বিযুক্ত মাংস খাওয়ান।
বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে বাচ্চারা অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাচ্ছে। যাকে অবেসিটি বা শারীরিক স্থূলতা বলে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বে ৫ বছরের কম বয়সের প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ শিশু শারীরিক স্থূলতায় আক্রান্ত এবং আরো বেশিসংখ্যক শিশু অতিরিক্ত ওজনের শিকার। সবার জন্য রিস্ক ফ্যাক্টর। ছেলেবেলার এই শারীরিক স্থূলতাই পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি করে। ফলে জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। সুতরাং আপনার সন্তানের ওজন পর্যবেক্ষণ করুন। ওজন অধিক হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-যাপনের অভ্যাসগুলো অনুশীলনের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্য বলতে শুধুমাত্র সুস্থতা বোঝায় না, মানসিক সুস্থতা এবং আত্মিক সুস্থতাও একটা বড় ব্যাপার। বাচ্চারা যখন বড় হয় তখন মানবিক গুণাবলীর যেন বিকাশ ঘটে সে শিক্ষা পরিবারের সদস্যদের দিতে হবে। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা অতীব জরুরী। যে ধর্মের অনুসারী আপনি হোন না কেন সেই ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দিন। ধর্মের পথে থাকলে মানুষ অন্যায় করতে পারে না। ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে সন্তানকে শিক্ষা দিন। সৎসঙ্গ সবার প্রয়োজন। সন্তানের সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করুন। ধূমপান, মাদক বা যে কোন নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে সন্তান যেন দূরে থাকে সে শিক্ষা দিন। সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তুলুন যেন সে সুস্থ হয়ে বেড়ে ওঠে এবং নিজের, পরিবারের, সমাজের এবং দেশের সম্পদ হয়ে গড়ে ওঠে।
শৈশব হতেই বাচ্চাদের কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে, যেমন-শারীরিক পরিশ্রম করা, সুষম পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, তামাক এবং তামাকজাত পণ্য এবং নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকা। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান শোনানো উচিত।
ছেলেবেলা থেকেই আপনার সন্তানকে জীবনের জন্য সুস্থ হার্ট; এ ব্যাপারে শিক্ষা দিন। হার্টের যত্ন নিতে শেখান। সুস্থ হার্টের জন্য সুন্দর জীবনধারা গড়ে তুলতে তাকে সহযোগিতা করুন। ব্যায়াম করার ব্যাপারে উৎসাহিত করুন। কিছু না কিছু খেলাধুলার সুযোগ করে দিন। কারণ খেলাধুলা আপনার সন্তানের সুন্দর স্বাস্থ্য, সুস্থ হার্ট গড়ে তুলবে। ছেলেবেলা থেকেই সুষম খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করুন। মিষ্টি, চকলেট এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য খাদ্যের পরিবর্তে আপনার সন্তানের হাতে ফলমূল তুলে দিন। মনে রাখবেন, আপনার সন্তান গড়ে তোলার কারিগর আপনি নিজেই।
যে সমস্ত ছেলে-মেয়েরা শৈশব থেকেই স্বাস্থ্যসম্মত জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তারা হ্নদরোগ ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে। তবে এটা ঠিক বাড়ির অভিভাবকদের এইরকম জীবনাচার করতে হবে। বাসার মধ্যে সুন্দর, সুশৃঙ্খল, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই সন্তান শিখবে, যার ফলে আমরা ভবিষ্যতে একটা নিরোগ প্রজন্ম পাবো এবং হ্নদরোগ প্রতিরোধ করতে পারবো।
উৎসঃ দৈনিক ইত্তেফাক, ০৯ ডিসেম্বর ২০০৭
লেখকঃ জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) এ মালিক
Leave a Reply