প্রকৃতিতে চলছে ঋতুর পালাবদল। শীত এগিয়ে আসছে তার রাজত্ব বিস্তারে। তাই বলে তাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে সঠিক প্রসাধনী নির্বাচন আর ত্বক পরিচর্যা করে এ সময়টাতে আপনি হয়ে উঠতে পারেন আরও সজীব, আরও সুন্দর।
আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ত্বকের পরিচর্যায়ও পরিবর্তন আনতে হয়। গরম ও শীতের সময় ত্বকের পরিচর্যা ভিন্নভাবে করতে হবে। শীতের সময় আর্দ্রতা কমে যায়। ত্বক অনেক বেশি রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে পড়ে। এ সময় ত্বকের সঠিক পরিচর্যা জরুরি। বলছিলেন রূপবিশেষজ্ঞ ফারজানা আরমান।
লেজার চিকিত্সা বিশেষজ্ঞ ঝুমু খান বলেন, শীতে প্রাকৃতিকভাবে ত্বকের আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় ত্বকে টানটান ভাব হতে থাকে। তবে শীত আসার আগেই যদি ত্বকের যত্ন নেওয়া হয়, তাহলে শীতের সময়ও ত্বক খুব ভালো থাকবে।
তাঁদের দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শীতে কীভাবে ত্বক ও চুলের যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
ত্বক থাকবে সতেজ
আমাদের দেশের মেয়েদের সাধারণত তৈলাক্ত, শুষ্ক, স্বাভাবিক—এ তিন ধরনের ত্বক দেখা যায়। তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে যে প্রসাধনী গরমে ব্যবহার করা হয়, সেটি বাদ দিতে হবে। ময়েশ্চারাইজারযুক্ত ফেইসওয়াশ ব্যবহার করুন। সপ্তাহে এক দিন মুলতানি মাটির প্যাক ব্যবহার করতে পারেন। মুখে একটি মাস্ক দিতে পারেন। লেবুর রস, ডিমের সাদা অংশ ও মধু একসঙ্গে মিশিয়ে ১০-১৫ মিনিট মুখে রেখে ধুয়ে ফেলুন, পরে ময়েশ্চারাইজার দিন। এতে ত্বকের অতিরিক্ত তেল ভাবটা কমে যাবে।
ফারজানা আরমান জানালেন, শুষ্ক ত্বকের ক্ষেত্রে ফেইসওয়াশ হিসেবে নিতে পারেন ক্রিমি ক্লিনজার বা গ্লিসারিন সোপ এবং ময়েশ্চারাইজার হিসেবে একটি ভারী ময়েশ্চারাইজার। বাড়ি বসে কলার সঙ্গে মধু মিশিয়ে বা পাকা পেঁপে মুখে লাগাতে পারেন। এতে ত্বকের শুষ্ক ভাবটা থাকবে না।
স্বাভাবিক ত্বকের ক্ষেত্রে ক্লিনজার বার ও তেলমুক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে পারেন। নিজেই একটা প্যাক বানিয়ে নিতে পারেন। গোলাপজল, দই ও মধু মিশিয়ে ত্বকে লাগান। এতে ত্বক কোমল থাকবে।
যাঁদের মুখের ত্বক খুবই স্পর্শকাতর, তাঁরা এ সময় খুব সমস্যায় ভোগেন। আর ফেসিয়াল ওয়াইপস ব্যবহার করতে পারেন। হালকা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। আর অবশ্যই রাসায়নিক পদার্থমুক্ত সানস্ক্রিন। লাগাতে পারেন একটি মাস্ক। টকদইয়ের সঙ্গে গমের গুঁড়া মিশিয়ে মুখে ১০-১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।
ঝুমু খান বলেন, পুরো শরীরের ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখার জন্য প্রাকৃতিকভাবে কিছু ময়েশ্চারাইজার রয়েছে, তা লাগাতে পারেন। যেমন, জলপাইয়ের তেল গোসলের আগে সারা গায়ে ম্যাসাজ করে তারপর গোসল সেরে নিন। তাহলে ত্বকের অতিরিক্ত শুষ্ক ভাবটা কেটে যাবে। ত্বকও খুব পরিচ্ছন্ন ও সজীব দেখাবে। কারণ ত্বকের যতটুকু তেল দরকার, সেটা শুষে নেওয়ার পর বাকিটা পানিতে ধুয়ে যায়। গোসলের পর তেল লাগালে চটচটে ভাব থাকে এবং ত্বকে ধুলাবালি আটকায়, তাই গোসলের আগে তেল ব্যবহার করাই ভালো। শীতে অনেকের ত্বকে সাবান ব্যবহারে সমস্যা দেখা দেয়। তাঁরা গোসলের সময় সাবানও বাদ দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে একটা সুতিকাপড় দিয়ে হালকা করে তেলটা মুছে নিতে পারেন। তারপর গোসল করুন। এতেও ভালো কাজ হয়।
আবার অনেক রকম ময়েশ্চারাইজিং বাথ পাওয়া যায়, সেগুলোও ব্যবহার করতে পারেন। সেটা সাবান ও ময়েশ্চারাইজার, দুটোরই কাজ দেবে।
শীতের রোদ কার না পছন্দ। কিন্তু তা ত্বকের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই এ সময় অবশ্যই নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। সানস্ক্রিন যেন অবশ্যই এসপিএফ ৩০-এর বেশি হয়।
যাঁদের স্বাভাবিক ত্বক, তাঁরা যেকোনো লোশন, সানস্ক্রিন অথবা কোল্ড ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। সমস্যা হয় শুষ্ক ও তৈলাক্ত ত্বক নিয়ে। যাঁদের শুষ্ক ত্বক তাঁরা গায়ে তেল লাগানোর পাশাপাশি মুখেও হালকা তেল লাগাতে পারেন। তাহলে গোসলের পর ত্বক শুষ্ক দেখাবে না।
মাথার তালুর ত্বক একসময় খুব শুষ্ক হয়ে যায় এবং খুশকি তৈরি হয়। সে ক্ষেত্রে ভারসাম্য রেখে শ্যাম্পু ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন ফারজানা আরমান।
প্রতিদিন অ্যান্টিড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুল পড়তে পারে, তাই একটানা অ্যান্টিড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার না করে মাঝেমধ্যে সাধারণ শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। শ্যাম্পু করার এক ঘণ্টা আগে তেল গরম করে মাথার তালুতে ম্যাসাজ করুন। এ ছাড়া টকদই আর হেনা একসঙ্গে মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগালেও অনেক উপকার পাওয়া যায়।
শীতের সময় হাত-পা রুক্ষ হয়ে যায়। অবহেলা ও সঠিক যত্নের অভাবে অনেকেরই হাত-পা ফেটে যায়। যদি শীতের শুরু থেকেই ময়েশ্চারাইজার লাগানো হয়, তবে তা হয় না। পেট্রোলিয়াম জেলিটা খুব কাজ করে ফাটার ক্ষেত্রে। এটা চটচটে বলে অনেকেই অপছন্দ করেন। তাঁরা বাজারে হাত ও পায়ের আলাদা যে ক্রিম পাওয়া যায়, তা দিনে ব্যবহার করতে পারেন। ঘুমোতে যাওয়ার আগে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করুন। তবে এসব ব্যবহার করেও যদি কোনো ফলাফল না পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই ত্বকবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
ঠোঁটের চাই বিশেষ পরিচর্যা
ত্বকের চেয়ে ঠোঁটের শুষ্কতা বেশি। শীতকালে তাই প্রায় সবারই ঠোঁট ফাটার সমস্যা দেখা যায়। এ সময় ঠোঁটে নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে রাখা জরুরি। লিপবাম, চ্যাপস্টিক, পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করুন। লিপস্টিক হিসেবে বেছে নিন ভিটামিন ই যুক্ত লিপস্টিক। এ ছাড়া সানস্ক্রিনযুক্ত লিপস্টিকও পাওয়া যায়, সেটি লাগাতে পারেন। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে গ্লিসারিন লাগান ঠোঁটে। ঠোঁট ভেজা অবস্থায় গ্লিসারিন ও পেট্রোলিয়াম জেলি লাগান।
যত্ন নিন নখের
শীতের সময় হাত ও পায়ের পাশাপাশি নখও শুষ্ক হয়ে পড়ে। ফেটে যায় ও অপুষ্টিতে ভোগে। সে ক্ষেত্রে ভিটামিন-ই ক্রিম লাগাতে পারেন। এতে নখভাঙা বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত নখও পায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি। নেইলপলিশটা এ সময় নিয়মিত ব্যবহার না করাই ভালো। নখ ও হাতের যত্নে আপনি গরমপানি ও শ্যাম্পুর মিশ্রণ ব্যবহার করতে পারেন। এ মিশ্রণে নখ কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে দুই চামচ চিনি ও এক চামচ মধু মিশিয়ে হাত ও নখে ১০-১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এতে হাত ও নখ কোমল হবে।
পায়েরও যত্ন নিন
হাত ও নখের মতো পায়েরও যত্ন নিন। বাইরে থেকে ফিরে সোডা মেশানো পানিতে পা ভিজিয়ে রাখুন। তারপর চিনি, লবণ ও মধু একসঙ্গে মিশিয়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করুন। এতে পায়ের মরা চামড়া উঠে যাবে। যাঁদের পা ফাটে তাঁরা পিউমিস স্টোন বা ঝামা দিয়ে পায়ের তলাটা ঘষে নিতে পারেন। মাসে অন্তত একবার মেনিকিউর ও পেডিকিউর করান।
শীতে হাঁটু, গোঁড়ালি, কনুইয়ের ত্বক একটু বেশি রুক্ষ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে গ্লিসারিন খুব কাজ করে। রাতে ঘুমানোর আগে গ্লিসারিন অথবা পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে নিন। সপ্তাহে একবার লেবু ও মধু মিশিয়ে ম্যাসাজ করতে পারেন।
এ সময় অনেকেরই নাকের দুই পাশে চামড়া ওঠার সমস্যা ও চোখের পাপড়িতে খুশকি হয়। তাঁরাও নিয়মিত ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে থাকেন। তবে এতে কাজ না হলে চিকিত্সকের পরামর্শ নিন।
শীতের প্রসাধনী বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটু সচেতন হোন। টিনএজার ও শিশুদের ক্ষেত্রে মৃদু প্রসাধনী বেছে নিন, যেগুলো রাসায়নিক পদার্থ ও অতিরিক্ত সুগন্ধিমুক্ত হবে। টিনএজারের ত্বককে খুব ম্যাসাজ করা যাবে না। এতে ত্বকের সমস্যা দেখা দিতে পারে। মৃদু ফেইসওয়াশ ব্যবহারের পাশাপাশি সপ্তাহে এক দিন স্ক্রাব ব্যবহার করতে পারেন। পাশাপাশি হালকা করে ক্রিম ও ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।
শীতে শুষ্কতার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের অ্যালার্জির সমস্যা হয়। তাই কোন পোশাকটি পরছেন তাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেরই উলের পোশাকে অ্যালার্জি থাকে, তাঁরা সোয়েটার বা শালের নিচে সুতির পাতলা কোনো পোশাক পরে নিন। অবশ্যই জীবাণুমুক্ত উপায়ে পোশাকটি পরিষ্কার করুন।
মডেল ও অভিনয়শিল্পী মীম ত্বকের যত্নের জন্য বেছে নেন ছুটির দিনকে। ঘরেই কিছু প্যাক তৈরি করে তিনি মুখে লাগান। এরপর মসুরের ডাল, মধু, ময়দা একসঙ্গে পেস্ট করে ত্বকে লাগিয়ে আধঘণ্টা রেখে তা ধুয়ে ফেলেন। এতে ত্বক অনেক সজীব হয়ে ওঠে। মীম শীতের সময় নিয়মিত ময়েশ্চারাইজিং লোশন ব্যবহার করেন। মেকআপের আগে তো অবশ্যই ময়েশ্চারাইজার লাগান। আর খুশকির হাত থেকে রেহাই পেতে রাতে মাথায় তেল গরম করে ম্যাসাজ করেন। পানিও পরিমাণমতো পান করেন। মীম মনে করেন, ত্বকের সজীবতায় খাদ্যাভ্যাসটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যা ভাস ভালো না হলে ত্বক সঠিক মাত্রায় পুষ্টি পাবে না। ফলে যত পরিচর্যাই করা হোক না কেন ত্বক সতেজ দেখাবে না। শীতে অনেক রকম মৌসুমি ফলমূল, শাকসবজি পাওয়া যায়। বিশেষ করে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ শাকসবজি রাখা উচিত খাদ্যতালিকায়। পাশাপাশি দুধ, ডিম ত্বকের জন্য উপকারী। আর সবচেয়ে বেশি উপকারী যেটি, সেটি হচ্ছে পানি। ত্বক সুস্থ রাখতে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। অবশেষে জয় করুন শীতের রুক্ষতা।
শান্তা তাওহিদা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply