খেয়ে যত মানুষ মরে, না খেয়ে তত মরে বলে মনে হয় না। বরং পুষ্টিমানে ভালো এমন খাবার পরিমিত পরিমাণে খেলে মানুষের শরীর ও মন বেশি টেকসই থাকে। অনেক গবেষণা থেকে দেখা গেছে, দৈনিক ক্যালরি সীমিত করলে আয়ু বাড়ে। ‘উনা ভাতে দুনা বল’ এমন একটা কথাও প্রচলিত। খাদ্যসংকট বলতে ‘খাদ্যের অভাব’ এমন একটি সমস্যা চোখের সামনে ভাসে আমাদের। তবে ভেজাল ও দূষিত খাদ্য যে আরও বড় সমস্যা, তা যেন আমরা বুঝতে চাই না।
শহরে-নগরে অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন আসে গ্রাম ও উপশহর থেকে। বাধ্য হয়েই তাদের খেতে হয় বাইরের খাবার। সামর্থ্য অনুযায়ী পেটে কিছু দিতে হয়। কেউ আহার করে নোংরা ড্রেনের পাশে বসা ‘ইটালিয়ান’ হোটেলে, কেউ ভাতঘরে, কেউ আরেকটু ভদ্র রেস্তোরাঁয়। দিনের পর দিন পোড়া তেলে ভাজা খাবার, হাত না ধুয়ে যে শ্রমিকটি রুটি বানাচ্ছে, তরকারি কুটে রান্না করছে, মাছি, তেলে-জলে-মাছে একাকার সেসব খাবার গলাধঃকরণ করছে তারা। ‘বিষে বিষ ক্ষয়’ বলে কথা আছে। সে জন্য কি এর পরও জীবন রক্ষা পায়? নাকি ‘শরীর মহাশয়’-এ জন্য শরীর সহ্য করে এমন দূষিত খাবারের বিষ! পাকা পেঁপে থেকে শুরু করে গুঁড়ো দুধ থেকে খনিজ পানি, কিসে নেই ভেজাল? হলফ করে বলা যাবে, কোন খাবারটি বিশুদ্ধ? দুধ, পানি, শাকসবজি, ফল, মাছ, মাংস-বিশুদ্ধ কোনটি?
খনিজ পানির বোতল কুড়ানিরা জমা দিচ্ছে রহস্যময় লোকের কাছে। এরপর দূষিত জলে ভর্তি হচ্ছে বোতল, রিসাইক্লিং হচ্ছে বাজারে। কোমল পানীয়-এতে তো আছে চিনি, জল আর গ্যাস (!)-সেই জলও যে বিশুদ্ধ, এমন গ্যারান্টি কি আছে?
কই মাছের প্রাণের চেয়ে কঠিন প্রাণ আমাদের। প্রাণবায়ু এত সহজে বেরোবে না। অন্য দেশের লোক এমন খাবার দিনের পর দিন খেলে দফা গয়া হতো।
তরল দুধ, গুঁড়ো দুধ, কিসে নেই ভেজাল! ইদানীং গুঁড়ো দুধে মেলামাইন মেশানো বলে খবর বেরিয়েছে। কিন্তু দোকানের তাকে এসব দুধের টিন শোভা বর্ধন করছে। নির্বাহী নির্দেশ না পেলে টিনগুলো তো নামবে না, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি সম্পর্কে ভাবার সময় কই? যারা সরবরাহ করেছে, তারা এসব ফেরত না নিলে টিনগুলো নামবে কেন? যাঁরা জানেন ভেজাল সম্পর্কে, তাঁরা নাহয় একটু রয়েসয়ে কিনলেন মনোহরি জিনিস; কিন্তু বেশির ভাগ লোকই তো এসব তত্ত্বকথা, সংবাদ তেমন জানে না। তারা বাধানিষেধের বোঝেই বা কী? পরীক্ষার ফলাফল পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে। টিভিতে বলা হচ্ছে, এখন এসব দুধের নমুনা বিদেশে পাড়ি দিয়েছে পরীক্ষিত হওয়ার জন্য। দেখা যাক, সর্বনাশ হওয়ার আগে যেন সবাই রক্ষা পায়। তবে এ সুযোগে বুকের দুধ জনপ্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে। গুঁড়ো দুধ তরল হয়ে ফিডিং বোতলে স্থান পেয়ে যে বাচ্চাদের মুখে ঢুকত নিপলের মাধ্যমে, এর চল কমবে। আরেকটু বড় যারা, এরা দুধ না পেলেও ঘরে অন্যরা যে খাবার খায়, সে খাবার খেলেও অপুষ্ট হবে না। বড় বিশেষজ্ঞরা তা-ই বলেছেন। যা হোক, এর সমাধানের দিকে চেয়ে রইলাম।
ফল খাব? ফলকে কার্বাইড দিয়ে পাকানো হচ্ছে। একসময় কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো হতো, এখন কিল-ঘুষি দিয়ে ফল পাকানো হচ্ছে না। প্রযুক্তি পাল্টে গেছে।
সবজি, শাকেও রাসায়নিক। রঙিন করার জন্য, নাকি তাজা রাখার জন্য? ডাবের পানিও নাকি সিরিঞ্জ দিয়ে বের করে অন্য পানি ঢোকানো হচ্ছে।
এমন দুষ্ট-প্রযুক্তি অলস লোকের মাথার আসে কি?
মাছ বর্মি না দেশি, সেই চেনাজানার ঝক্কি তো আছেই।
বড় ঝক্কি হলো ফরমালিনমুক্ত মাছ চেনা। শব তাজা রাখার জন্য টেক্সিডার্মিস্টরা এনাটমির মরাঘরে যা ব্যবহার করেন, তা এখন মাছের বাজারে ঢুকেছে।
মাংস? খাসির মাংস কেনা ভাগ্যের ব্যাপার। দেখে, বেছে, নিজের সামনে জবাই করা, ছিলানো-এসব পুরো কর্মকাণ্ড স্বচক্ষে দেখে করলে তবে খাসির মাংস ভক্ষণ করা সম্ভব হতে পারে।
তেলে ভেজালের কথা বললে রচনাটি অনেক লম্বা হয়ে যাবে। থাক তাহলে, শহরে যাঁরা আসছেন কাজকর্মে বাইরে, তাঁরা কী খাবেন? চিঁড়ে গামছায় বেঁধে, সঙ্গে গুড়, কলা, বোতলে ফোটানো জল। কেমন? মুড়িও আনা যাবে।
তবে তা ইউরিয়ামুক্ত হলে হয়। ৪০ টাকার মুড়ি, নাকি ৬০ টাকার মুড়ি? কলা নেপালি, না দেশি তাতে কি, একে রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে না পাকালেই হলো। গুড়ে বালি না থাকলেই হলো। এরপর ঢকঢক করে জল পান করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বাসে উঠবেন বাদুড়ঝোলা হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য···।
এ রকম ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের মূল্য শুনলে পিলে চমকে ওঠে। এ তো আশ্চর্য ব্যাপার। এসব শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে কখন? অপেক্ষায় থাকি!
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকাসূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৯, ২০০৮
Leave a Reply