টিভি চালিয়ে ঘুমানো কি উচিত?
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে সমস্ত প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি সেগুলি আমাদের নিদ্রা, ওজন, অবসাদের স্তর এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে, সে বিষয়ে একাধিক গবেষণা করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া ও ২৪ ঘণ্টার সংবাদমাধ্যম ব্যক্তির জীবনে কেমন প্রভাব ফেলে, সে বিষয়েও নানা সমীক্ষা করা হয়েছে। এমনকি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং টিভি-র মতো ডিভাইস আমাদের স্বাস্থ্যকে কী ভাবে প্রভাবিত করছে, সে বিষয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। এগুলির মধ্যে একাধিক বিষয় এখনও গবেষণাধীন। তবে সর্বসম্মতি ক্রমে বলা যেতে পারে যে, ঘুমানোর সময় এই ধরণের প্রযুক্তি থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে, অবশ্যই তা করুন। আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফোন ব্যবহার করা অনুচিত। একই কারণে নিদ্রা বিশেষজ্ঞ এবং সমীক্ষকরা টিভি চালিয়ে ঘুমানোর পরামর্শ দেন না। টিভি চালিয়ে ঘুমাতে অভ্যস্ত হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে এর ফলে ঘুমের গুণমান কমতে পারে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে।
টিভি চালিয়ে না ঘুমানোর ৪টি কারণ
নিদ্রা সমীক্ষা এবং বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, টিভি চালিয়ে ঘুমানোর ফলে স্বপ্ন, হরমোন ও স্বাস্থ্যে কুপ্রভাব পড়তে পারে।
১. পর্যাপ্ত ঘুমে বাধা সৃষ্টি হতে পারে, বাড়তে পারে স্লিপ ডেব্ট বা ঘুমের ঋণ
বিশেষজ্ঞদের মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতি রাতে ৮ ঘণ্টার ঘুম প্রয়োজন। এর থেকে কিছুক্ষণের ব্যাঘাতও কাম্য নয়। কোনও ব্যক্তি যদি ৬ ঘণ্টা ঘুমায়, তা হলে অবশিষ্ট ২ ঘণ্টা তাঁর স্লিপ ডেব্ট। অন্য যে কোনও ঋণের মতোই এই ঋণও এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। এটি ব্যক্তির স্পষ্ট চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়াকে বাধিত করে এবং লক্ষ্যে স্থির থাকার ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। টিভি চালিয়ে ঘুমোলে ব্যক্তির ঘুমের পরিমাণ কমে যেতে পারে, যা হয়তো তাঁরা ভাবতেও পারেন না। এর ফলে ঘুমের ঋণও বাড়তে থাকে। টিভিতে নিজের পছন্দের অনুষ্ঠান চালিয়ে চোখ বুজে শুয়ে রয়েছেন, অথচ ঘুমোননি। এমন পরিস্থিতিতে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাই স্বাভাবিক। এর ফলে ঘুমের পরিমাণ কমবে এবং ঋণ বাড়বে।
২. মেলাটোনিন উৎপাদন কমায়
মেলাটোনিন এমন একটি হরমোন যা আমাদের ঘুমাতে সাহায্য করে। এই হরমোনই শরীরকে ইঙ্গিত দেয় যে, ঘুমানো বা বিশ্রাম করার সময় হয়ে গিয়েছে। টিভি বা এমন কোনও ডিভাইস যা নীল রশ্মি উৎপন্ন করে, তা শরীর দ্বারা উৎপাদিত মেলাটোনিনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এর ফলে দিন বা রাত সম্পর্কে মস্তিষ্ক কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। মস্তিষ্ক যদি মাঝরাতকে দিন ভেবে নেয়, তা হলে নিদ্রার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার প্রক্রিয়াও বাধিত হয়।
৩. মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে
মস্তিষ্ক যদি উদ্দীপিত হতে থাকে, তা হলে তা ব্যক্তিকে সক্রিয় রাখে। সক্রিয় মস্তিষ্ককে সহজে নিষ্ক্রিয় করা যায় না, এর ফলে নিদ্রা যাওয়া হয়ে ওঠে অত্যন্ত কঠিন। মস্তিষ্ক উদ্দীপিত থাকলে শরীরের পক্ষে উপযোগী গভীর ও পর্যাপ্ত ঘুম লাভ সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিশেষজ্ঞদের মতে টিভি দেখা বা শুধু শোনা মস্তিষ্ককে অনেক বেশি উদ্দীপিত করে দেয়। টিভি চালিয়ে ঘুমালে, টিভির ফ্ল্যাশ লাইট, ধ্বনি পরিবর্তন, নতুন অ্যালার্ট এক ঝটকায় ব্যক্তির ঘুম ভেঙে দিতে পারে। এমনকি গভীর ঘুমে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টিভির আওয়াজের অনুরণন আমাদের মস্তিষ্কে থেকে যায়। এর অর্থ, মস্তিষ্ক টিভির আওয়াজ গ্রহণ করে চলেছে এবং ক্রমশ উদ্দীপিত হচ্ছে। ফলে স্বপ্নেও ব্যাঘাত ঘটতে পারে। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার পর ব্যক্তি অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। এ কারণে ঘুমের পরিমাণ ও গুণ দুইই কমে যায়।
৪. স্বাস্থ্যে প্রভাব বিস্তার করেত পারে
টিভি চালিয়ে ঘুমোনোর কারণে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। উচ্চরক্তচাপ, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলার মতো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় উঠে আসে যে, কৃত্রিম আলো (যেমন টিভির আলো)-র সাহায্যে ঘুমালে ওবেসিটির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে যে, ঘুমের গুণ ও পরিমাণ না-কমলেও এ ধরণের আলোর কারণে মেদবাহুল্যের ঝুঁকি বাড়ে। অতএব, টিভি চালিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারলেও, এটি স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি কুপ্রভাব বিস্তার করে।
তবে টিভি চালিয়ে ঘুমোনো যে খুব একটা ভুল আইডিয়া নয়, তার সমর্থনেও চারটি যুক্তি পেশ করা যায়—
১. হোয়াইট নয়েস হিসেবে কাজ করতে পারে এটি
অনেকেই টিভির মৃদু ধ্বনিকে হোয়াইট নয়েস হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি তাঁদের ঘুমোতে সাহায্য করে। টিভিতে চলতে থাকা কোনও অনুষ্ঠানের ডায়লগ বা প্লট না-শুনলেও তার ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড উপভোগ করেন তাঁরা।
২. অন্য ডিভাইসের তুলনায় টিভি থেকে কম পরিমাণে নীল রশ্মি নির্গত হয়
মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপের তুলনায় টিভির নীল রশ্মির ঘনত্ব অনেক কম। কম নীল রশ্মি নির্গত হওয়ার কারণে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনাও কম থাকে।
৩. চেনা পরিচিত ধ্বনি ব্যক্তিকে ঘুমাতে সাহায্য করে
ঘুমানোর সময় গান শুনলে উন্নতমানের নিদ্রা লাভ সম্ভব হয়। ইনসমনিয়ার চিকিৎসায় মিউজিক কার্যকরী উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিছু সমীক্ষকদের মতে টিভি-তে আসা কোনও অনুষ্ঠানের চেনাপরিচিত ধ্বনিও একই কাজ করে।
৪. চেনাপরিচিত ফিকশনাল জগৎ অবসাদ কমাতে পারে
এমন কিছু অনুষ্ঠান বা সিনেমা রয়েছে যা দেখে ব্যক্তি তাঁর জীবনের কঠিন সময় নিজের চাপ ও অবসাদ কমাতে পারে। এর পিছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তিও থাকতে পারে। ২০১২ সালের একটি সমীক্ষায় জানা গিয়েছে চেনাপরিচিত ফিকশানাল জগৎ ব্যক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করে এবং স্বনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ায়। পছন্দের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে ঘুমালে মস্তিষ্ক স্বস্তি পায়। তাই মাঝেমধ্যে টিভি চালিয়ে ঘুমানো যেতে পারে। তবে অ্যাকশান মুভি বা লাইভ নিউজ চ্যানেল চালিয়ে ঘুমোবেন না।
আবার টিভিতে স্লিপ টাইমার লাগিয়েও ঘুমোনো যেতে পারে। এর ফলে নির্দিষ্ট সময় পর টিভি নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে। আবার সারা রাত টিভি চলতে দেওয়ার পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময় টিভি বন্ধ হয়ে গেলে নীল রশ্মির সংস্পর্শও শীঘ্র ত্যাগ করা যাবে।
ভালো ঘুমের টিপস
অবসাদগ্রস্ত ব্যক্তি শীঘ্র ঘুমাতে পারে না। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে পর্যাপ্ত ঘুম লাভ করা যেতে পারে—
১. সন্ধেবেলা কফি পান করবেন না।
২. দিনেবেলা খুব দেরি করে খাবেন না।
৩. দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস ত্যাগ করুন।
৪. মদ্যপান এড়িয়ে চলুন।
৫. দিনের বেলা সূর্যরশ্মির সংস্পর্শে থাকার চেষ্টা করুন।
৬. এক্সারসাইজ করুন, তবে ঘুমাতে যাওয়ার আগে করবেন না।
৭. ঘুমের সময় নির্ধারিত রাখুন, এমনকি ছুটির দিনেও যাতে এর ব্যাঘাত না-ঘটে লক্ষ্য রাখবেন।
৮. মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে।
৯. ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্নান করুন।
১০. বিছানা ও শয়নকক্ষ যাতে আরামদায়ক হয়, সে বিষয় লক্ষ্য রাখুন।
১১. শয়নকক্ষে রাতের বেলা আলো বেশি থাকে, তা হলে স্লিপ মাস্ক পরুন।
অনেকেই টিভি চালিয়ে ঘুমাতে অধিক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তবে বিশেষজ্ঞরা এই উপায়ের বিরুদ্ধে। কারণ এর ফলে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে, শরীরের মেলাটোনিন উৎপাদন বাধিত হয়, মস্তিষ্ককে অধিক সক্রিয় রাখে।
তবে টিভি ছাড়া এক্কেবারেই ঘুমাতে না-পারলে চেনাপরিচিত হাল্কা মেজাজের অনুষ্ঠান দেখুন। টিভিতে টাইমার লাগিয়ে রাখতে ভুলবেন না।
Health and Fitness Tips in Bengali শরীর-গতিক, Yoga and Exercise Tips in Bangla
2021-05-10 16:32:14
Source link
Leave a Reply