ফাহিম কিছুতেই বুঝতে পারছে না, ‘আর্টসেলের’ কনসার্টে যাওয়া নিয়ে মায়ের অসুবিধা কোথায়? বেশ কয়েকবার বুঝিয়ে ফাহিম অনুমতি তো পেলই না, না যেতে দেওয়ার কারণটাও ধরতে পারল না। ওদিকে বন্ধুরা সব উত্তেজনায় কাঁপছে। ফাহিম বন্ধুদের বোঝাতে পারছে না ওর না যাওয়ার কারণটি। মায়ের ওপর এত অভিমান হলো, ‘নাহ্, আর কথাই বলব না।’ সেই থেকে ২১ দিন ধরে ফাহিমের কঠিন অভিমান। কথা হতো শুধু প্রয়োজনের সময়, তাও খুবই কাট-কাট। মা ভেবেছিলেন, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, নিজেও ছেলের সঙ্গে জেদ করছেন। এটা ঠিক হচ্ছে না।
সহজ হতে গিয়ে দেখলেন, ছেলের রাগ ভেঙেছে, কিন্তু বেশ দেরি হয়ে গেল। একটা শূন্যস্থান যেন তৈরি হয়েছে মা-ছেলের সম্পর্কে। ফাহিম আগে মায়ের কাছে যেভাবে আবদার করত, এখন আর তা নেই বললেই চলে। মায়ের প্রতি অভিমান স্থান নিয়েছে তার মনে।
মিম্মীর গল্পটা অন্য রকম। এবার নবম শ্রেণীতে উঠেছে মিম্মী। মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। তাই মা-বাবাকে খুব কম কাছে পায় মিম্মী। একটা সময় দেখেছে, মা-বাবা ক্লান্ত। সময় নেই মিম্মীর সারা দিনের রাজ্যের গল্পগুলো শোনার। ইচ্ছা থাকলেও মা-বাবা যেমন পারেন না, মিম্মীও বলতে পারে না। আস্তে আস্তে অনেক চুপ হয়ে গেছে মিম্মী। রাগ নয়, একটা অভিমান। মিম্মীর কাছে তার মা-বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা-বাবা। তবুও সম্পর্কে অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছে চাপা একটা অভিমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনস্তত্ত্ব বিভাগে পড়াশোনা করে এখন ভারতে উচ্চশিক্ষার জন্য পড়ছেন ফারহানা কবীর। বেশ কিছু দিন ঢাকার একটি ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে ছেলেমেয়েদের কাউন্সেলিংয়ে জড়িত ছিলেন ফারহানা। ফারহানা মনে করেন, ১৪ থেকে ১৯ বছরের মানুষগুলো বয়ঃসন্ধির সময়টা পার করে যুবক বয়সে প্রবেশ করে। বয়ঃসন্ধিকালও প্রভাব ফেলতে থাকে। শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তনও একটি আকার পায়। একই সঙ্গে পরিবার, কাছের মানুষ ও সমাজ তাদের পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গ্রহণ করতে থাকে। আমাদের দেশে তো এমনিতেই বয়ঃসন্ধিকালে বৈশিষ্ট্য ও আমাদের করণীয় বিষয়গুলো অজানা। উন্নত দেশগুলোতে ‘প্যারেন্টিং’ কিংবা এ বিষয়গুলো নিয়ে যে চর্চা হয়, এখানে তা প্রায় অনুপস্থিত। তাই আমাদের কী ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত পরিবার কিংবা সমাজ থেকে, তা জানি না, বুঝতেও পারি না। ফলে ছেলেমেয়েরাও একধরনের হীনম্মন্যতায় ভুগতে থাকে। এ সময় তাদের মন-মানসিকতা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় থাকে। খুব সহজেই ভালো থাকা মনটি বিষণ্নতার দিকে মোড় নেয়। অনেককে দেখা গেছে বিষণ্ন ও চুপচাপ থাকার মধ্যেই যেন স্বচ্ছন্দ খুঁজে পায়। বিষণ্নতা থেকে মান-অভিমান, ক্ষোভ ও রাগের দিকে এগিয়ে যায়। এ বয়সের বেশ কিছু ছেলেমেয়ের সঙ্গে ফারহানা কথা বলে জানতে চেয়েছিলেন, কেন এমন হয়, কেন মা-বাবা কিংবা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। বেশ কিছু উত্তরের মধ্যে ছিল, ‘যখন দেখি মা-বাবা তাঁদের মতো বুঝে নিচ্ছেন, আমাকে বুঝতে চাচ্ছেন না, তখন মনে হয়, কথা বলে কী লাভ’, ‘যা বোঝাতে চাই, মা-বাবা ভুল বোঝেন’, ‘তাঁদের সঙ্গে বিষয়গুলো পরিষ্কার হতে ভয়, অস্বস্তিবোধ ও লজ্জা কাজ করে।’
ফারহানা মনে করেন, ছেলেমেয়েদের এসব সমস্যার প্রতিকার মা-বাবা ও পারিবারিক দৃঢ় বন্ধন আর সুসম্পর্কের মধ্যেই মিলবে। আমরা বারবার মা-বাবাদের এ কথাগুলোই বুঝিয়ে বলতে চাই। পরিবারের সুসম্পর্ক ছেলেমেয়েদের সমস্যাগুলো অনেকাংশে লাঘব করে। ছেলেমেয়েরা যদি জেদ করে, আমাদের তো আর তাদের সঙ্গে জেদ করা চলে না। তা ছাড়া এ সময়টিতে অনেক ধৈর্য ধরতে হয় দুই পক্ষকে। কথা বলার ওপর আর কোনো চিকিত্সা যেন নেই। কথা বলার দরজা খুলে রাখতে হবে দুই পক্ষ থেকেই। ছেলেমেয়েদেরও বুঝতে হবে, মা-বাবার মতো বিশ্বস্ত বন্ধু আর হতেই পারে না। পৃথিবীর কেউ তাদের পাশে থাকুক না থাকুক, মা-বাবা সব সময়ই ভালোবাসার বন্ধনে আলিঙ্গন করে রাখবেন তাঁদের সন্তানদের। আর রাগ বা অভিমান করে চুপ করে থাকা বা কথা বন্ধ করলে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। এতে নিজের ক্ষতির হিসাবও তো করা চাই। মা-বাবাদের বলছি, আপনারা নিশ্চিত করুন আপনাদের প্রতি ছেলেমেয়ের বিশ্বাস, তাদের বুঝতে দিন সে আপনাদের জন্য কত মূল্যবান ও ভালোবাসার।’ সময় তো বদলে গেছে। এখনো সেই পুরোনো দিনের মতো মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব হবে সাত সমুদ্র তেরো নদী দূর? মোটেও নয়। মা-বাবা ও পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক হবে নির্ভরতা, বিশ্বাস ও অনেক বেশি ভালোবাসার। তাই মুঠোফোনের বিজ্ঞাপনগুলোর মতো বলতে হয়, কথা চলুক প্রাণ খুলে প্রিয়জনের সঙ্গে।
শিখতী সানী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৭, ২০০৯
Leave a Reply