প্রশ্নটা সবার মনেই ঘুরপাক খায়। সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের কত ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন? সে যা-ই হোক, বিভিন্ন কারণে অনেকেই ঠিকভাবে ঘুমাতে পারে না। সাধারণভাবে একে আমরা ইনসমনিয়া বা না ঘুমানো রোগ বলে থাকি। আবার অনেকের মধ্যে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ঘুমানোর প্রবণতা দেখা যায়। ‘ঘুম হলো অবচেতন মনের একটা মধ্যবর্তী অবস্থা। মানসিক সব ধরনের চিন্তা থেকে এ সময় মস্তিষ্ক নিজেকে বিরত রাখে।’ কথাগুলো বলছিলেন মনোরোগবিশেষজ্ঞ ডা· ফিরোজ খান। তিনি জানালেন ঘুম নিয়ে নানা কথা।
ঘুমাব কতক্ষণ
মানুষের বয়সভেদে ঘুমানোর সময়ও আলাদা হয়ে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ঘুমানোর সময়টা দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা। পূর্ণ বয়স্ক সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোই যথেষ্ট। আবার বেশিক্ষণ ঘুমানোর চেয়ে কতটুকু ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো, এটাও বিবেচনায় আনতে হবে। দিনের বেলায় যদি ঘুমানোর অভ্যাস থাকে তো তা বাতিল করুন। দিনের বেলার ঘুম শরীরে বাড়তি মেদ জমায় এবং আলস্য আনে।
ঘুম হয়না কেন
একটুখানি নিয়মমাফিক চললে ঘুম নিয়ে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। যখন মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো দুর্বল হয়ে পড়ে তখন ঘুম এসে দুই চোখের পাতায় ভর করে। আবার অনেকের বেশি খাওয়া-দাওয়া করলেও ঘুমানোর প্রবণতা দেখা যায়। অনেকের মতে, মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ কম হলেও অনেক সময় ঘুম পায়।
ভালো ঘুম না হওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, মানুষের শারীরিক নানা রকম সমস্যা হলে ঘুম একেবারেই হয় না। যাদের বয়স একটু বেশি তাদের ক্ষেত্রে বয়সজনিত রোগগুলো ঘুম থেকে বিরত রাখে। এসবের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগগুলোর প্রভাব বেশি দেখা যায়। আবার যাদের বাত, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে, তারাও ঘুম নিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়।
মানসিক নানা কারণেও ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের বেলায় পরীক্ষা বা চাকরির কোনো ব্যাপার নিয়ে টেনশন থাকলে অনেক সময় রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। মানুষের মন ও মস্তিষ্ক দুটোই যখন নানা কারণে উত্তেজিত থাকে, তখন ভালো ঘুম হয় না। আপনজনের মৃত্যুর শোকে শরীর ও মস্তিষ্কের প্রতিটি ইন্দ্রিয়ে রক্তচাপ বাধা পাওয়ার কারণে ঘুম আসে না। নেশাজাতীয় দ্রব্য নেওয়ার ফলে অনেক সময় ঘুম আসে না। অনেক সময় দেখা যায়, এক ব্যক্তি তার শোয়ার স্থানটি পরিবর্তন করলে ঘুম আসে না। প্রচণ্ড নাক ডাকার শব্দ, শোয়ার জায়গার সমস্যা এবং শোয়ার জায়গায় দুর্গন্ধ হলে ঘুম আসবে না। প্রচণ্ড আওয়াজ অথবা তীব্র আলোতে কখনোই ঘুম আসে না। মশার কামড়, রাত জেগে আড্ডা দেওয়া এবং নোংরা বিছানায়ও অনেকের ঘুমের সমস্যা হয়। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, চা, কফি ও সিগারেটের কারণে ঘুম কম হয়। যে কারণেই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটুক না কেন, সে বিষয়ে খানিকটা সচেতন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ঘুম হচ্ছে না, এ কারণে চিন্তায় অস্থির হওয়া ঠিক নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ নেওয়া উচিত নয়।
নিয়মগুলো মানতে হবে
নিয়ম-শৃঙ্খলা জীবনের সবকিছু পাল্টে দিতে পারে। সবকিছুই সাজিয়ে দেয় সুন্দর করে। ঘুমের ক্ষেত্রেও এটা অনেকটাই জরুরি। কিছু নিয়ম মেনে চললে ঘুম আপনাআপনি চলে আসবে। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমানোর এবং ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করতে হবে। অধিক রাত অবধি যদি কোনো কাজ ফেলে রাখা হয়, তা ঘুমের সমস্যা করতে পারে। আগেই কাজটি শেষ করার চেষ্টা করতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘুমাতে যাওয়ার সময় এবং ঘুম থেকে ওঠার সময় ছাড়া কখনোই বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। ঘুমাতে যাওয়ার আগের দুই ঘণ্টা চা, কফি, সিগারেট খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। ঘুমানোর আগে ভারী ব্যায়াম করলে ঘুম আসে না।
–প্রতিদিন অন্ততপক্ষে সকালবেলায় নিয়ম করে ব্যায়াম করার চেষ্টা করা উচিত। হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, বিভিন্ন ধরনের যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন করার চেষ্টা করা যায়।
–রাতের খাবার প্রতিদিন একই সময় খাওয়ার চেষ্টা এবং খানিকটা ক্ষুধা থাকতেই খাওয়া থেকে বিরত থাকা।
–রাতে ঘুমানোর আগে ঠান্ডা পানি দিয়ে মাথা ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে গা, হাত ও পা মুছতে হবে-যদি ঠান্ডার সমস্যা না থাকে।
–ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভালো লাগা যেকোনো বিষয়ে ভাবা যেতে পারে। পড়া যেতে পারে পছন্দের কোনো বই বা ম্যাগাজিন। আবার শোনা যায় হালকা সুরের কোনো গান।
–ঘুমানোর আগে মনে মনে বলা যায়, ‘আমি পারব। সব পারব।’ আবার ভাবা যায়, আমি অনেক সুখী মানুষ। দেখা যাবে, গভীর একটা ঘুম হচ্ছে।
–ঘুম না এলে শুধু শুধু বিছানায় এপাশ-ওপাশ করা ঠিক নয়।
সূত্রঃ প্রথম আলো, অক্টোবর ২৮, ২০০৮
Leave a Reply