হাইলাইটস
- মংপুর সুরেল। শেষ এপ্রিলের এক বিকেল।
- সমতলের লোকজন বৈশাখের দাবদাহে রোস্ট হলেও মংপু পাহাড়ে মনোরম আবহাওয়া।
- এমন সুন্দর পাহাড়ী বিকেলেও মৈত্রেয়ী দেবীর এতটুকু ফুরসৎ নেই। কি ব্যাপার!
“গদ্যজাতীয় ভোজ্যও কিছু দিয়ো,
পদ্যে তাদের মিল খুঁজে পাওয়া দায়।
তা হোক, তবুও লেখকের তারা প্রিয়-
জেনো, বাসনার সেরা বাসা রসনায়।”
-নিমন্ত্রণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মংপুর সুরেল। শেষ এপ্রিলের এক বিকেল। সমতলের লোকজন বৈশাখের দাবদাহে রোস্ট হলেও মংপু পাহাড়ে মনোরম আবহাওয়া। এমন সুন্দর পাহাড়ী বিকেলেও মৈত্রেয়ী দেবীর এতটুকু ফুরসৎ নেই। কি ব্যাপার! তবে কি সেদিন রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) সে দিন আসার কথা? উহু তিনি তো এ বাড়িতে উঠেছেন সপ্তাহখানেক আগেই। তবে এমন ব্যস্ততা কিসের? কারণ, রবিবাবুর হঠাৎ করেই ছেলেমানুষী গুলো নতুন করে উস্কে উঠেছে। আর সেসব ছেলে মানুষীর সমস্ত আবদার মেটাতে হয় মৈত্রেয়ী দেবীকেই। কি আবদার করলেন রবিবাবু? তিনি মারমালেড দিয়ে ছাতু মেখে সবাইকে খাওয়াবেন। এমন আবদার শুনে সবাই আঁতকে উঠলেন। এমন কিম্ভুত রেসিপি কস্মিন কালেও কেউ চোখে দেখেনি। চেখে দেখা তো দূর কি বাত। সবাই অবাক হয়ে বললে-” মারমালেড দিয়ে ছাতু?”
রবিবাবুর (Rabindranath Tagore) অবশ্য এসব প্রশ্নে কোনো হেলদোল নেই। তিনি শিশুর মতো সরলতায় উত্তর দিলেন-” নয় তো কি? অতি উপাদেয় সুখাদ্য। আনাও না ছাতু। এক সময়ে ভালো ছাতু মাখিয়ে বলে আমার নাম ছিল, মেজদার টেবিলে মারমালেড দিয়ে ছাতু মাখতুম”।
অতএব খোঁজ শুরু হল ছাতুর। কিন্তু বন পাহাড়ের দেশে যবের ছাতু মিলল না। শেষে মুড়ির ছাতুর ব্যবস্থা করা হল। রবিবাবু (Rabindranath Tagore) বললেন -“বেশ তাতেই হবে”। তারপর মারমালেড, গোল্ডেন সিরাপ, আদার রস, দুধ কলা মাখন দিয়ে প্রায় আধঘন্টা ধরে ছাতু মাখতে লাগলেন রবিবাবু। মৈত্রেয়ী দেবী রসিকতা জুড়লেন-” আপনার রসুনটাই বা বাদ যায় কেন? একটু পেঁয়াজের রসও পড়ুক না!”
“বটে? খেয়ে দেখো একবার”- উত্তর দিলেন রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore)।
সন্ধ্যেবেলা ছাতু মাখা শেষ হল। এবার তা সবার মধ্যে ভাগ করার পালা। রবিবাবুই সে দায়িত্ব নিলেন। প্লেটে প্লেটে ভাগ করা হল। কিন্তু মুখে তুলেই সবাই বুঝল স্বাদ মোটেই সুখকর নয়। মৈত্রেয়ী দেবীকে জিজ্ঞেস করলেন রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath)-” কি কিরকম?”
মৈত্রেয়ী দেবী হেঁয়ালি করে দিলেন উত্তর-” চমৎকার! এতো রোজ খেলেই হয়”
এমন স্ত্রী সুলভ চাতুরী সহজেই ধরতে পারলেন রবীন্দ্রনাথ। ব্যস, তারপর ছেলে মানুষের মতো সমস্ত দোষ চাপিয়ে দিলেন ছাতুর উপর-” তোমাদের ছাতুর দোষ গো, ছাতুর দোষ, তা না হলে ভালো না হয়ে যায়ই না!”
অতএব পরের দিন রবিবাবুর ফরমায়েশ মতো যব ভেজে গুঁড়ো করে ছাতু বানানো হল। আবার সে সন্ধ্যায় ছাতু মাখতে বসলেন রবিবাবু। যদিও ছাতু পাল্টালেও স্বাদ বিশেষ পাল্টায়নি সেদিন। খাওয়া দাওয়া এমন এক্সপেরিমেন্ট বা কাব্যরসে নিমজ্জিত খাদ্যরস, এ কিন্তু ঠাকুর পরিবারের রক্তে।
“আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে–
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে”
এ কবিতার সাথে অনেকেই পরিচিত । রবিবাবু তাঁর ছেলেবেলায় লিখেছিলেন। তবে খাদ্যরসসিক্ত এমন কাব্যরস সৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথই ঠাকুর বাড়ির পথিকৃৎ তা বোধহয় নয়। এ গুণের অধিকারী ছিলেন রবিবাবুর বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথও। ‘গুম্ফ-আক্রমণ কাব্য’এর দ্বিতীয় সর্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখলেন-
“চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় অতিমাত্র উপাদেয়
ভুঞ্জে লোক দুঃখ-শোক ভুলি।
মশাল কোটার চোটে, হামানদিস্তায় ওঠে
ঠুং-ঠাং শব্দ অবিরল।
সৌরভ তথায় কিবা বিচরিছে রাত্রি-দিবা
মনোভৃঙ্গে করয়ে পাগল।।
একপ্রস্থ ভাজাভুজি, সম্মুখে হইলে পুঁজি
আর তাহা ফিরিয়া না যায়।
তারপরে উপনীত, লুচি-মোন্ডা মনোনীত,
ফলমূল পরের দফায়।।
বৃহৎ রূপার থালে পাচক ব্রাহ্মণ ঢালে,
মাংসের পোলাও গাদা-গাদা ।।
কি গুণ পাঁঠার হাড়ে, অম্বলের তার বাড়ে
কে বুঝিবে ইহার মর্যাদা।।”
একবার উঁকি মারা যাক ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে। সে সময়কার প্রায় সকল অভিজাত পরিবারের মহিলাদের মতোই ঠাকুর বাড়ির (Thakurbari) মহিলারাও দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর গল্প গুজবের জন্য জড়ো হতেন ছাদে। সেই সময় যদি একটু ঘুরে আসা যায় জোড়াসাঁকোর (Jorasanko) ছাদে, দেখা যাবে কোনো কোণে রোদে কেটে রাখা জারক লেবু। দু চারজন মেয়ে বউ গামলা ভরা কলাই বাটা থেকে বড়ি বানিয়ে রোদে দিচ্ছে। এক কোণে কাঁচা আম ফালি করে কেটে আমসি করতে দেওয়া হয়েছে। ছোটো বড়ো নানা সাইজের কাজ করা পাথরের ছাচেঁ জমিয়ে রাখা হচ্ছে আমের রস। রোদ খাওয়া সর্ষের তেলে মজে উঠছে এচড়ের আচার। তৈরি হচ্ছে কেয়া খয়ের।
সেবার জ্যোতিদাদার বিয়ে হল। বাড়িতে এল রবীন্দ্রনাথের বউঠাকুরণ কাদম্বরী। কাদম্বরী যে ভালো রাঁধতে পারতেন সে কথা স্বীকার করেছেন স্বয়ং রবিবাবু। আর বউঠাকুরণের রান্না করার রবির প্রিয়তম পদ? চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি সাথে লঙ্কা দিয়ে মাখা পান্তা।
রবীন্দ্রনাথ যখন বিয়ে করে আনলেন মৃণালিনীকে , স্ত্রীর কাছেই রবীন্দ্রনাথের যত বিচিত্র রান্নার আবদার। মানকচুর জিলিপি, দইয়ের মালপো, পাকা আম দিয়ে তৈরী মিষ্টি, চিঁড়ের পুলি সবই মৃণালিনী বানালেন রবীন্দ্রনাথের আবদারে। একবার মৃণালিনী পয়লা বৈশেখের দিন তৈরি করলেন একধরনের মিষ্টি। নাম তার ‘এলোঝেলো’। রবীন্দ্রনাথের বেশ লাগল এটি। কিন্তু এমন সুস্বাদু মিষ্টির এমন বিশ্রী নাম! রবীন্দ্রনাথ দিলেন তার নাম পাল্টে। নতুন নাম হল-‘ পরিবন্ধ’। এলোঝেলো এখনকার মিষ্টির দোকানে খুব একটা চোখে পড়ে না। এটা অনেকটা ঝাল মিষ্টি স্বাদের জিভে গজা ধরনের। পুরনো একটি রান্নার বইতে এলোঝেলোর রেসিপি মিলল। একেবারেই ছোট রেসিপি। ছোট্ট করে বলেই ফেলি- দু কাপ চিনি দেড়কাপ জলে ফুটিয়ে তিন চারটে ছোট এলাচের গুঁড়ো মিশিয়ে নিতে হবে। একটা পাত্রে নুন ময়দা সাদা তেল কালো জিরে মিশিয়ে ভালো করে মেখে নিতে হবে। এবার মাখা ময়দার তাল থেকে পাতলা করে ছুরি দিয়ে কেটে নিন। তারপর হাত দিয়ে চেপে নির্দিষ্ট শেপে নিয়ে আসুন। তারপর কড়াইয়ের সাদা তেলে ভেজে নিয়ে গরম সিরায় কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখুন।
ঠাকুর বাড়ির রান্নার উদ্ভাবনের প্রসঙ্গ উঠলে হেমেন্দ্রনাথ আর নীপময়ীর কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরীর কথাই বা ভুলি কী করে! রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশতম জন্মদিনে তিনি বানিয়েছিলেন নতুন ধরনের মিষ্টি-‘কবিসম্বর্ধনা’বরফি। কী ছিল সে মিষ্টির উপাদান? ফুলকপি, খোয়া ক্ষীর, বাদাম,কিশমিশ, জাফরান পাতা। মিষ্টির উপর সোনা রূপার তবক জড়ানো।
এত সব পড়ার পর প্ৰথম খেয়ালে আসে, রবীন্দ্রনাথ বোধহয় পেটুক ছিলেন। সম্ভবত এটা সত্যি নয়। রবীন্দ্রনাথ খাদ্যরসিক ছিলেন বটে। কিন্তু তিনি মিতাহারী। স্বল্পাহারী বললেই মনে হয় যুক্তিযুক্ত হয়। রবীন্দ্র সংস্পর্শে এসেছেন এমন প্রায় সব ব্যক্তিই প্রত্যক্ষ করেছেন স্বল্পাহারী রবীন্দ্রনাথকে। সেই যে ছেলেবেলার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছেন খাদ্য পরিবেশন কালে ভৃত্যদের কৃপণ স্বভাবের কথা, ভৃত্যদের এই স্বভাবটিই হয়ত ছোটবেলা থেকেই রবিবাবুকে করেছে স্বল্পাহারী।
রবীন্দ্রনাথ যদি খাদ্যরসিক হন,তবে তাঁর প্রিয় খাবার কোন গুলি? রবীন্দ্রনাথ সে ব্যাপারে আলাদা করে কিছু লেখেননি।
তবে এই রবিবাবুই যখন লেখেন দুধে আমসত্ত্ব ফেলার কবিতা কিংবা দামোদর শেঠের মন মেজাজের সাথে জুড়ে দেন- মুড়কির মোয়া, ভেটকি ফ্রাই, বোয়ালের পেটি বা কাঁকড়ার ডিম, কৌতুহল হয়, দামোদর শেঠেকে ঢাল করে রবিবাবুই কি জানান দিলেন তাঁর খাদ্যরসের! কৌতুহল তো তখনও জাগে যখন, নৌকাডুবিতে মাছ খেতে খেতে রমেশ বলেন-” স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, এ যে রুই মাছের মুড়ো রোহিত মৎসের উত্তমাঙ্গ”। এই কৌতুহলের অবসান ঘটে, যখন রবীন্দ্রনাথ সুরেন্দ্রনাথ কন্যা জয়শ্রীর বিয়েতে লেখেন ‘পরিণয় মঙ্গল’-
“যদি কোনো শুভদিনে ভর্তা না ভর্ৎসে,
বেশি ব্যয় হয় পড়ে পাকা রুই মৎস্যে,
কালিয়ার সৌরভে প্রাণ যবে উতলায়,
ভোজনে দুজনে শুধু বসিবে কি দু ‘ তলায়।
লোভী এ কবির নাম মনে রেখো, বৎসে”।
রবীন্দ্রনাথের খাদ্যরস নিয়ে যখন এত গপ্প জুড়েছি সেসময় হলে এতক্ষণে আজকের দিনে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত সেই তেতলার ঘরের সামনের টানা বারান্দায় এতক্ষণে পাত পড়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কাছে রন্ধন শুধু উদরপূর্তির মাধ্যম ছিল না। সাহিত্যের মতো রন্ধনকেও শিল্পসম জ্ঞান করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
ঋণ স্বীকার- ছেলেবেলা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল- চিত্রা দেব
বিবাহ বাসরের কাব্যকথা-চিত্রা দেব
মংপুতে রবীন্দ্রনাথ- মৈত্রেয়ী দেবী
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভারবি
আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১শে এপ্রিল ২০১৮
Lifestyle News in Bengali, লাইফস্টাইল খবর, Health Tips, Fashion Trends and Tips in Bangla
2021-05-09 11:16:56
Source link
Leave a Reply