মূত্রতন্ত্র কী
মূলত কিডনি ও কিডনি থেকে যেসব নালি প্রস্রাবের থলিতে চলে গেছে এবং যার মাধ্যমে প্রস্রাবের নির্গমন হয়, সেই মূত্রপথের সমন্বয়ে মূত্রতন্ত্র গঠিত। জীবাণু যদি এই তন্ত্রে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়, তাহলে সে অবস্থাকে বলা হয় মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন।
মূত্রতন্ত্রের প্রদাহের প্রকারভেদ
মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ মূলত তিন প্রকার। প্রথমত, কোনো উপসর্গবিহীন সংক্রমণ। এ ধরনের সংক্রমণে কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, শুধু মূত্রাশয় ও মূত্রপথ আক্রান্ত হলে তাকে বলে নি্ন মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ। তৃতীয়ত, যদি কিডনি স্বয়ং এই সংক্রমণে আক্রান্ত হয়, তখন তাকে বলে আপার ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন বা পায়লোনেফ্রাটিস। চতুর্থত, উভয় ধরনের প্রদাহ। এ ক্ষেত্রে মূত্রপথ থেকে জীবাণু মূত্রাশয় ও মূত্রনালি হয়ে কিডনি পর্যন্ত পৌঁছে পায়লোনেফ্রাটিস করতে পারে। অর্থাৎ দুই ধরনের প্রদাহ একই সঙ্গে হতে পারে।
উপসর্গ
মূত্রতন্ত্রের প্রদাহের উপসর্গ তার আক্রমণের স্থানভেদে আলাদা। আগেই বলা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, যেগুলোকে উপসর্গবিহীন সংক্রমণ বলা যায়। যদি মূত্রতন্ত্রের নিচের অংশ বা মূত্রাশয়, প্রস্রাবের নালি ইত্যাদি আক্রান্ত হয়, তাহলে এই উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে-
–প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া।
–ঘন ঘন প্রস্রাব।
–প্রস্রাব করার সময় ব্যথা।
–প্রস্রাবে প্রচণ্ড চাপ, অথচ পরিমাণে কম আসা।
–আরও প্রস্রাব করার ইচ্ছে।
–তলপেটে ব্যথা এবং ভার ভার।
–প্রস্রাবে দুর্গন্ধ।
–প্রস্রাবের রং ঝাপসা।
–ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাব।
–লালচে বর্ণের প্রস্রাব।
কিডনি আক্রান্ত হলে যে উপসর্গগুলো থাকে তা হচ্ছে-
–কোমরের দুই পাশে ব্যথা, ঠিক নাভির উল্টোদিকে।
এসব ক্ষেত্রে জীবাণু সাধারণত রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। সেসব ক্ষেত্রে সাধারণ উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন-জ্বর, কাঁপুনি, দুর্বলতা, বমি বমি ভাব, বমি হতে পারে। উপসর্গবিহীন এক ধরনের প্রদাহ রয়েছে। এ ধরনের সংক্রমণ কিছু ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব বহন করে। বিশেষত, গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে এর চিকিৎসা জরুরি। এ ছাড়া মূত্রতন্ত্রে কোনো অপারেশনের আগেও এর চিকিৎসা জরুরি। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এ অবস্থার চিকিৎসা দরকার নেই। মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গে প্রদাহ থাকলে তা থেকে মূত্রাশয়ের প্রদাহ আলাদা করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে উল্লিখিত উপসর্গ মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ছাড়াও হতে পারে।
মূত্রতন্ত্রের ওপরের অংশের প্রদাহ (পায়ালোনেফ্রাইটিস)
এটি মারাত্নক প্রদাহ। চিকিৎসা না করা হলে এটি কিডনি নষ্ট করে ফেলতে পারে। কিডনি পুঁজে ভরে যেতে পারে।
কীভাবে জীবাণু মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে
সাধারণত মূত্রপথ থেকে প্রস্রাবের থলি বা মূত্রাশয়, সেখান থেকে মূত্রনালির মাধ্যমে এই জীবাণু কিডনি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। যে জীবাণু নিয়ে প্রস্রাবের প্রদাহ হয়, এর ৯৫ ভাগ জীবাণু বসবাস করে খাদ্যনালি বা বৃহদন্ত্রে। পায়খানা করার পর যদি এই জীবাণু মূত্রপথের সংস্পর্শে আসে, তখন প্রদাহ হয়ে থাকে। সাধারণত মেয়েদের এই প্রদাহ পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে।
মেয়েদের কেন এই প্রদাহ বেশি হয়
প্রথমত, তাদের মূত্রনালির দৈর্ঘ্য ছোট্ট। এ ছাড়া মূত্রপথ মলদ্বারের কাছাকাছি থাকায় জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার সুযোগ বেশি। তৃতীয়ত, মিলনের সময় জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
কাদের মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ বেশি হয়
–যারা পানি কম খায়।
–প্রস্রাব আটকে রাখে।
–যাদের ডায়াবেটিস আছে।
–গর্ভবতী মায়েদের।
–যাদের মূত্রতন্ত্রে বাধা রয়েছে।
–পুরুষদের প্রস্টেট-গ্রন্থি বড় হলে।
–মূত্রনালিতে পাথর হলে।
–যাদের কিডনি দুর্বল।
–বয়স ষাটের বেশি।
–রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা কম।
রোগ নির্ণয়
প্রথমত, রোগের ইতিহাস নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বয়স, লিঙ্গ, প্রস্রাবের নালিতে বাধাজনিত রোগ, প্রস্টেট বড় কি না, উপসর্গ কোন ধরনের ইনফেকশনের পরিচয়বাহী, কোমরে ব্যথা, জ্বর, কাঁপুনি আছে কি না প্রভৃতি বিবেচনায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে (প্রস্রাব ও রক্ত) প্রস্রাবের কালচার করলে জীবাণু শনাক্তকরণ এবং কোন ওষুধ কাজ করবে তাও জানা যায়। কালচার করার সময় প্রস্রাব সংগ্রহের পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে সংগৃহীত হলে সেই প্রস্রাব কালচার করলে জীবাণুর উপস্থিতি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং চিকিৎসাও সঠিক হবে।
প্রস্রাব সংগ্রহের নিয়ম
প্রথমে মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব থেকে একটি জীবাণুমুক্ত পাত্র সংগ্রহ করুন। এরপর টয়লেটে গিয়ে আপনার অঙ্গ সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। টিস্যু পেপার বা শুকনো কাপড় দিয়ে শুকিয়ে নিন। এমন করে প্রস্রাব সংগ্রহ করুন, যাতে মূত্রপথের পাশের অঙ্গে স্পর্শ না লাগে। প্রথম অংশের প্রস্রাব বাদ দিয়ে মাঝখানের অংশ সংগ্রহ করুন। কেননা, প্রথম অংশের প্রস্রাবে মূত্রপথের আশপাশের জীবাণু বা বহিরাগত জীবাণুর উপস্থিতি থাকতে পারে, যা পরীক্ষায় ভুল রিপোর্ট দিতে পারে।
গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে উপসর্গবিহীন সংক্রমণের কারণে গর্ভের শিশুর ওজন কম, নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রসব হওয়া ইত্যাদির আশঙ্কা খুব বেশি। এসব ক্ষেত্রে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার বেশি। তাই গর্ভবতী মায়েদের প্রস্রাবে উপসর্গবিহীন জীবাণু শনাক্তকরণের জন্য গর্ভকালে কমপক্ষে দুবার করে প্রস্রাব পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া জরুরি।
জটিলতা
সাধারণত সঠিক চিকিৎসা করালে এর জটিলতা অত্যন্ত কম। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা না করালে জটিলতা দেখা দিতে পারে, যা অনেকাংশে মারাত্মক। যেমন-
কিডনি নষ্ট হওয়াঃ প্রদাহ থেকে কিডনি স্থায়ীভাবে নষ্ট হতে পারে।
সেপসিসঃ প্রদাহ রক্তে প্রবেশ করে সেপসিস এবং ক্ষেত্রবিশেষে জীবনসংহারী সেপটিসিমিয়া হতে পারে। এ অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক। দ্রুত চিকিৎসা না করা হলে মৃত্যুও হতে পারে। তবে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সময়মতো চালু করতে পারলে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।
বারবার প্রদাহ হওয়াঃ যেসব ক্ষেত্রে মাস-দুই মাস পরপরই মূত্রতন্ত্রে প্রদাহ দেখা দেয়, তাকে বলে বারবার প্রদাহ হওয়া। এ রকম বারবার প্রদাহের কারণ দুটি হতে পারে।
১· অপর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসার কারণে আগের জীবাণু যদি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল না হয়ে থাকে, তাহলে সেই জীবাণু নতুন করে সংক্রমণ করতে পারে।
২· সম্পূর্ণ নতুন কোনো জীবাণু ভিন্ন কোনো স্থানে নতুন প্রদাহও তৈরি করতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অন্তত ২০ থেকে ৩০ শতাংশ মূত্রাশয়ের প্রদাহ পুনরায় হওয়া প্রদাহ। যাদের মূত্রতন্ত্রের জ্নগত গঠনে সমস্যা থাকে অথবা প্রস্রাবে বাধাজনিত রোগ থাকে, তাদের বারবার প্রদাহ হতে পারে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার বেশ কম। তবে বয়স বেড়ে গেলে প্রোস্টেট বড় হয়ে প্রস্রাবের গতি ব্যাহত করে। ফলে প্রস্রাব থলিতে জমে থাকে, সে কারণেই এদের বেশি প্রদাহ হয়। এই প্রদাহ বারবার হতে পারে এবং এর চিকিৎসা করা দুরূহ।
প্রদাহের ঝুঁকিপূর্ণ কারণ
মূত্রাশয়ের প্রদাহের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো হচ্ছে-
মেয়েদের ক্ষেত্রেঃ মিলনের সময় মূত্রপথ দিয়ে ব্যাকটেরিয়া মূত্রাশয়ে চলে যায়। ফলে মিলন মূত্রাশয়ের প্রদাহের একটা বড় কারণ।
যেসব নারী বিভিন্ন স্পার্মিসাইড, কৃত্রিম ডায়াফ্রাম ব্যবহার করে, তাদের ঝুঁকি আরও বেশি। গর্ভবতী মায়েদের বেশি বেশি মূত্রাশয়ের প্রদাহ হয়ে থাকে। এর কারণ তাদের মূত্রনালি মোটা হয়, ফলে প্রস্রাবের ধারণ বাড়ে। এভাবে প্রস্রাব জমে গিয়ে প্রদাহ হয়। গর্ভাবস্থায় বেশি বেশি ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন প্রস্রাব দিয়ে নির্গত হয়, ফলে শরীরে ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
–আগে মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হয়ে থাকলে পরে মূত্রাশয়ের প্রদাহ হওয়ার হার খুব বেশি।
–মাসিকের সময় অস্বাস্থ্যকর প্যাড ব্যবহার করলে তা থেকেও প্রদাহ হতে পারে।
–পোস্ট মেনোপজাল বয়সে বা রজঃচক্র বন্ধ হওয়ার পরও মেয়েদের মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হওয়ার হার খুব বেশি।
পুরুষদের ক্ষেত্রেঃ মূত্রতন্ত্রের প্রদাহে ঝুঁকির কারণগুলো হলো-
–প্রোস্টেট-গ্রন্থি বড় হওয়া।
–মুসলমানি না করা হলে লিঙ্গের অগ্রভাগের ত্বকের ভাঁজের ভেতর ব্যাকটেরিয়া জমে গিয়ে প্রদাহ করতে পারে।
–অসংযমী মিলন।
–শারীরিক সম্পর্কের সময় সঙ্গীর কাছ থেকে।
–এইচআইভি বা এইডস রোগীর ক্ষেত্রে।
মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ প্রতিরোধ
–প্রচুর পরিমাণে পানি ও অন্যান্য তরল পান করতে হবে।
–প্রস্রাব আটকে রাখা যাবে না। যখন প্রস্রাবের বেগ হবে তখনই প্রস্রাব করতে হবে।
–ক্যানবেরি জুস নামে এক ধরনের ফলের রস পাওয়া যায়। এ জুস খেলে মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ কমে যায়।
–কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
মেয়েদের জন্যঃ
–মিলনের পরপরই ভালো করে পরিচ্ছন্ন হতে হবে এবং প্রস্রাব করতে হবে।
–প্রোটেকশনে স্পার্মিসাইড বা কৃত্রিম ডায়াফ্রাম ব্যবহার করা যাবে না।
–মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ঘন ঘন বদলাতে হবে।
–অস্বাস্থ্যকর স্প্রে ব্যবহার করা যাবে না।
–ডিওডারেন্ট ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট করে।
পুরুষদের জন্যঃ
–মুসলমানি করানো হলে ইনফেকশন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
–নিয়মিত ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা।
অধ্যাপক ডা· এম এ সামাদ
মূত্রতন্ত্র ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ
সূত্রঃ প্রথম আলো, অক্টোবর ২২, ২০০৮
Leave a Reply