‘আমি কোনো পাপ করি নাই, আল্লাহ আমার কপালে লিখছে, তাই দুই ছেলেই অন্ধ হইয়া জন্ম নিছে।’ এভাবেই নিজের মনকে শান্ত রাখেন জুবাইদা নাসরিন। পাবনার ভেলুপাড়া গ্রামের নাসরিন জানান, তাঁর দুই ছেলেরই জ্ন হয়েছে জ্নগত ছানি নিয়ে। বড় ছেলের বয়স ১২ ও ছোট ছেলের তিন। বড় ছেলের চোখের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতাল ও চিকিৎসকের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে লাভ হয়নি। শুধু নাসরিন নন, আরও হাজার হাজার মা সন্তানের অন্ধত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর আই হেলথ এবং লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ২০০১-০৩ সালে করা একটি গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০ হাজার শিশু কোনো না কোনোভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং এদের প্রায় ১২ হাজার শিশু ছানিজনিত কারণে অন্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে অন্ধ হতো না এরা। আরও ১০ হাজার শিশু অন্ধ হতো না, যদি তাদের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো। শিশুর দৃষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে, জুবাইদা নাসরিনই এর প্রমাণ। তিনি বড় ছেলের বেলায় অবহেলা করলেও ছোট ছেলে রওনকের বেলায় ছিলেন অনেক বেশি সচেতন। রওনকের ছানির অস্ত্রোপচার হয়েছে ঢাকার শান্তিনগরে চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশন (সিএসএফ) ও ওয়াহিদা মতিন মেমোরিয়াল ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে ওয়াহিদা মতিন মেমোরিয়াল সিএসএফ চাইল্ড ভিশন সেন্টারে। রওনককে শনাক্তকরণ, অস্ত্রোপচার, ফলো-আপ, যাতায়াত, হাসপাতালে থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করছে সিএসএফ। ওই সহায়তার ফলেই নাসরিনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে ছেলের চিকিৎসা করানোর। এ ভিশন সেন্টারে কথা হয় রিপন আহমেদের সঙ্গে। সাভারের ফুলবাড়িয়ার মোহাম্মদ আলী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রিপন জ্ন থেকেই ছানির সমস্যায় আক্রান্ত ছিল।
শান্তিনগরের ভিশন সেন্টারে বিনামূল্যে রিপনের ডান চোখে অস্ত্রোপচার করে লেন্স সংযোজন করা হয়েছে। ডান চোখে এখন পুরোপুরি দেখতে পাচ্ছে। বাঁ চোখে আবছা দেখতে পায় সে। এখানে কর্তব্যরতরা জানান, রিপনের বাঁ চোখের অবস্থা আশাব্যঞ্জক নয়। বিভিন্ন জায়গায় চিকিৎসা এবং দেরি করায় এ চোখে অস্ত্রোপচারেও তেমন ভালো ফল পাওয়া যাবে না।
সাভারে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্লাইন্ড মিশনের মাধ্যমে চাইল্ড সাইট ফাউন্ডেশনের সহায়তায় রিপনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক সময় অভিভাবক বুঝতেই পারেন না যে শিশুটি চোখের গুরুতর সমস্যায় আক্রান্ত। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাদানকারী চিকিৎসকেরাও অনেক সময় ছানিসহ চোখের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিতকরণে সময় অপচয় করেন। যখন অভিভাবকেরা সমস্যা অনুধাবন করেন, তখন শিশুকে নিয়ে কোথায় যাবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চোখের আলো হারিয়ে একটি শিশু জীবনের তরে পরিবার ও সমাজের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা সরকারি সেবা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে শিশুরা চোখের সেবা পাচ্ছে, যা দেশের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
দেশে বর্তমানে শিশু চক্ষুবিশেষজ্ঞের সংখ্যাও খুব কম-মাত্র নয় থেকে ১০। ২০০০ সালে সরকার আন্তর্জাতিক কর্মসূচি ‘ভিশন ২০২০’-এ অঙ্গীকার করেছে প্রতিরোধযোগ্য অন্ধত্ব নিরসনের।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিশু বিভাগের প্রধান ডা· জামাল নিজামুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের চোখের বিষয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছে। সরকারি অবকাঠামোর ভেতরে শিশুদের চক্ষুসেবা দেওয়ায় সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুদের চক্ষু বিষয়ে একটি বিভাগ চালু করার ওপর গুরুত্ব দেন।
এ ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে এসেছে বেসরকারি সংগঠনগুলো। অরবিস ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতাল, খুলনা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও মৌলভীবাজারে বাংলাদেশ জাতীয় অন্ধকল্যাণ সমিতিগুলোতে শিশুচক্ষু বিভাগ পরিচালিত হচ্ছে।
মানসুরা হোসাইন
সূত্রঃ প্রথম আলো, অক্টোবর ২২, ২০০৮
Leave a Reply