ভাবুন নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে
প্রতিবছর ১৮ অক্টোবর মেনোপজ দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশেও ‘বিশ্ব মেনোপজ দিবস’ উপলক্ষ করে কিছু কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি। এ সোসাইটিরও কাজ হচ্ছে বয়স্ক নারীদের স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলোর সমাধান ও দিকনির্দেশনা দেওয়া।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। এদের গড় আয়ু ৬২ বছর। সরকার অনুমোদিত উন্নত স্বাস্থ্য প্রকল্প ও মেয়েদের বিনা বেতনে শিক্ষা ইত্যাদির বদৌলতে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ক্রমে কমলে নারীদের গড় আয়ু আরও বাড়বে। ফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনসংখ্যা, যার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই, তাদের জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময় কাটবে মেনোপজে। জীবনের শেষভাগের এই সময়টা অর্থবহ ও কর্মক্ষম রাখার জন্য আগে থেকে যদি কিছু দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়, তাহলে তা বেশ কাজে আসবে এ জনগোষ্ঠীর। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বাস করে গ্রামে। মেনোপজ বা নির্দিষ্ট বয়সে ঋতু বন্ধ নিয়ে তাদের জানার বা করার কিছু নেই। তাদের জীবনে মেনোপজ আসে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মচক্রে দিনের পর রাতের মতো। তাদেরই সচেতন করে তুলতে হবে এ সময়কার গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য-প্রস্তুতির পরিচর্যায়। কেননা তারাই এ দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এ বছর মার্চে জুরিখে অনুষ্ঠিত মেনোপজ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রথম বিশ্ব সম্মেলনে ৪৭টি দেশের সচেতন বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও সমাজসেবীদের সম্মেলনে এবং মিডিয়ার অংশগ্রহণে এ বয়সের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। ধনী দেশগুলোয় মেনোপজ সোসাইটি এ খাতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা এবং উন্নত চিকিৎসা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করে আসছে।
এ বিষয়ে বহুল প্রচলিত ও আলোচিত হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা বা এইচআরটি ছিল সেমিনারের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এ সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্যের ওপর আলোকপাত করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেসব আলোচনা ও সিদ্ধান্তের ক্রোড়পত্র পরে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ১২তম বিশ্ব মেনোপজ সম্মেলনে (মে ২০০৮) সাড়ে তিন হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারীর মধ্যে বিতরণ করা হয়; যাতে দেশে-বিদেশে এ বিষয়ে কর্মরত স্বাস্থ্যসেবীরা এটি অনুধাবন করে নিজ দেশ ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন।
এ রকম একটি প্রচেষ্টায় যাদের নিরলস আন্তরিক ও একনিষ্ঠ পরিশ্রম কাজ করছে তার নাম ইন্টারন্যাশনাল মেনোপজ সোসাইটি। এর সঙ্গে কাউন্সিল অব দি এফিলিয়েটেড মেনোপজ সোসাইটি নির্ধারিত ও বিভিন্ন দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কাজ করে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটির প্রতিনিধিও আছেন। বয়সী নারী ও পুরুষ উভয়ের উন্নত স্বাস্থ্যের জন্য এঁরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এবার বিশ্ব মেনোপজ দিবসে নির্ধারিত ্লোগান হচ্ছে ‘নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবুন, অগ্রসর থাকুন’।
যে বিষয়গুলো এ বয়সে বিশেষভাবে চিন্তা বা সমস্যার কারণ হয়ে থাকে সেগুলো হচ্ছে জীবনযাত্রার মান, হরমোন প্রতিস্থাপন চিকিৎসা ও স্তন ক্যান্সার।
আপনি যখন চল্লিশের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে অথবা পঞ্চশের কোঠায়, তখন আপনার শরীর কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে। কেননা সে সময় আপনার ডিম্বাশয়ে মাসিকনিয়ন্ত্রক হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন তৈরি ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলবে। আপনি যদি সময়মতো নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে এসব পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত করেন, তাহলে কষ্ট অনেক কমে যাবে, জীবনটা বোঝার মতো মনে হবে না এবং সময়টাকে অর্থপূর্ণ ও উপভোগ্য করে তোলা যাবে।
পরিবর্তন ও সমস্যাগুলো কী
— হঠাৎ খুব গরম লাগা, বিশেষ করে শরীরের ওপরের অংশে একটা গরম ভাপের ঢেউ খেলে যেতে পারে। শরীরটা ঘেমে মাথা ঘুরে অস্থিরতা হতে পারে (হট ফ্ল্যাশ)।
— রাতে ঘাম হলে ঘুমের অসুবিধা হয়, শরীরে জ্বালা ভাব হয়।
— বিষণ্নতা ও ক্লান্তিবোধ শরীরকে করে তোলে অবসন্ন। ্নরণশক্তি ও মনোযোগের অভাব হতে পারে।
— যোনিপথ ও আশপাশের ত্বকের পরিবর্তনের কারণে ত্বক হয় শুষ্ক ও পাতলা। চুলকানি ও প্রদাহ হতে পারে ঘন ঘন।
— মাংসপেশি ঢিলা হয়ে যাওয়া ও প্রদাহের কারণে প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ কমে আসা ও ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে।
— রক্তে চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গেলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হতে পারে।
— হাড়ের ক্ষয় হয় ত্রিশোর্ধ্ব বয়স থেকে। মেনোপজে গেলে তা বেড়ে যায়। ফলে ভঙ্গুর হাড় সহজে ভেঙে গিয়ে অনেক দিন ভোগান্তি হতে পারে।
— বুক ধড়ফড় করা ও মাথাব্যথা হতে পারে।
কীভাবে ভালো থাকবেন
— স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাত্রা প্রণালী অনুসরণ করা। নিয়মিত ব্যায়াম বা কিছু শরীরচর্চা, হাঁটা, যোগাসন ইত্যাদির সাহায্যে শরীরটাকে ‘ফিট’ রাখা।
— সহজপাচ্য সুষম খাদ্যাভ্যাস। নির্ধারিত সময়ে পরিমিত খাদ্য গ্রহণ। গুরুপাক, তেল-ঝোল-মসলা-মিষ্টি ও প্রাণিজাত প্রোটিন কম খাওয়া বা বর্জন।
— রাতের বেলায় হালকা খাবার খাওয়া।
— খাদ্যতালিকায় বেশি করে রঙিন শাকসবজি, ফলমূল ও প্রচুর তরল বা পানীয় রাখা। ক্যালসিয়াম ও মিনারেলসমৃদ্ধ খাবার-দুধ, দই, ছানা, ছোট মাছ ইত্যাদিও রাখতে হবে।
— সারা দিন কাজের ফাঁকে দুপুরে কিছু সময় বিশ্রাম ও রাতে পাঁচ-ছয় ঘণ্টার একটা নিরুদ্বেগ ঘুম শরীরটাকে রাখতে পারে ঝরঝরে ও মনকে সতেজ।
— বছরে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা, যার মধ্যে বিশেষ করে স্তন, জরায়ুমুখ, জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের পরীক্ষা দরকার। হাড়ের সমস্যার জন্য রক্তে ক্যালসিয়াম বা বোন মিনারেল ডেনসিটি পরীক্ষা।
— কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা অনেক সময় বেশি কষ্টকর হতে পারে, তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
— চিকিৎসক আপনাকে এসব সমস্যার বিশেষ চিকিৎসা দেবেন-দরকারে প্রয়োজনে প্রয়োগের মাধ্যমে।
এই হরমোন চিকিৎসার ব্যাপারেই বিশদ আলোচনা ও গবেষণা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এর প্রয়োগ হবে প্রয়োজনে এবং চিকিৎসা চলবে যার জন্য যত দিন প্রয়োজন। সাধারণত দীর্ঘ সময় এ চিকিৎসা দেওয়া হয় না। এ চিকিৎসা সবার জন্য প্রযোজ্য নয় এবং নিয়মাবলিও হবে ভিন্ন প্রয়োজন ও শরীর বুঝে। সময়মতো শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি আপনাকে এই হরমোন চিকিৎসামুক্ত রাখতে পারে।
ওপরে যে নিয়মগুলো বর্ণনা করা হলো তা যদি আপনি মেনোপজের বেশ আগে থেকে শুরু করেন, তাহলে মেনোপজ আপনাকে সমস্যা বা কষ্ট কম দেবে।
ব্রি· জে· (অব·) ডা· সুরাইয়া রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ মেনোপজ সোসাইটি
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply