স্তন সম্পর্কে জানার কৌতূহল থাকলেও অনেকে প্রসঙ্গটি স্পর্শকাতর ভেবে একে এড়িয়ে যান। এ জন্য স্তনের অসুখ এমনকি ক্যান্সার সম্পর্কেও ভ্রান্ত ধারণা অনেকের মনেই থেকে যায়। অনেকে মনে করেন, স্তনে গুটি হলেই ক্যান্সার, তাও ঠিক নয়। আগাম শনাক্ত হলে একে যে ঠেকানো যায়-এ কথাও অনেকে জানে না। ক্যান্সার অনেকটাই প্রতিরোধযোগ্য, নিরাময়যোগ্য-ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। আগাম শনাক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা বলেছেন, ‘টিএলসি-টাচ লুক, চেক’। স্তন স্পর্শ করে দেখুন অস্বাভাবিক কোনো কিছু হাতে লাগছে কি না (টাচ), চোখ দিয়ে দেখুন স্তনে অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না (লুক), কোনো কিছু অস্বাভাবিক মনে হলে চিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করান (চেক)।
বুকের দ্বিতীয় পাঁজর থেকে স্তনের নিচের ভাঁজ থেকে কুক্ষি পর্যন্ত এর বিস্তৃতি, বুকের পেশির ওপর এর স্থিতি। স্তনের টিস্যুর এক-তৃতীয়াংশই চর্বি।
প্রতিটি স্তনে রয়েছে স্তনবৃন্ত, এতে দুধনালির মুখ। প্রতিটি স্তনবৃন্তের চারদিকে গাঢ় এলাকা ‘এরিওলা’। লোব ও লোবিকার সমন্বয়ে স্তন টিস্যুর গঠন, দুধ উৎপাদনে এগুলোর ভূমিকা অনেক। দুধ প্রবাহিত হয় দুধনালি দিয়ে, যুক্ত রয়েছে লোবের সঙ্গে। এরপর স্তনবৃন্তে দুধনালির মুখে। স্তন ক্যান্সারের বেশির ভাগ হয় দুধনালিতে, লোবে হয় কেবল ১০ শতাংশ।
স্তনে রয়েছে সংবহনতন্ত্র, ধমনি, শিরা, স্মায়ু, লসিকাগ্রন্থি ও লসিকানালি। স্তন ক্যান্সার হলে এই লসিকানালি ও শিরা দিয়ে ছড়াতে পারে শরীরের অন্যত্র। স্তন ক্যান্সার অনেক সময় ছড়ায় লসিকাগ্রন্থিতে প্রথমে। কুক্ষিদেশের লসিকাগ্রন্থিতে। ক্যান্সারের কোষগুলো অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘মেটাসটেসিস’। স্তন-সচেতনতার ব্যাপারে কিছু অগ্রাধিকারের বিষয় নির্ধারণ করেছে বিশেষজ্ঞ ফাউন্ডেশন।
— অগ্রাধিকার-১: ম্যামোগ্রাম।
যেসব নারীর তেমন কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ নেই, তাদের ক্ষেত্রে আগাম চিহ্নিত করার উপায় হলো স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাম। ৪০-৪৯ বছরের নারী-বছরে একবার। ৫০ বছরের ঊর্ধ্বে-প্রতি দুই বছরে একবার। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ভিত্তিতে স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাম রয়েছে নানা দেশে।
— অগ্রাধিকার-২: নিজের স্তন সম্পর্কে অবহিত হওয়া। স্বাভাবিক স্তন সম্পর্কে ধারণা নেওয়া। স্তনে কী কী পরিবর্তন দেখতে হবে বা স্পর্শ করে রোধ করতে হবে, তা জানা।
স্তনে যেসব পরিবর্তন ঘটলে নজর করতে হবে-
নতুন কোনো গুটি দেখা গেলে বা কোনো স্থান অতিরিক্ত পুরু হলে। স্তনের ত্বক কুঁচকে গেলে বা টোল দেখা গেলে বা ত্বকের রঙে পরিবর্তন দেখা গেলে। স্তনবৃন্তে কোনো পরিবর্তন দেখা গেলে, স্তনবৃন্ত থেকে রস ক্ষরণ হলে বা বৃন্তটি ভেতরের দিকে উল্টে গেলে।
কিছু জিনিস ্নরণে রাখতে হবে
কোনো নতুন বা অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন নজরে আসছে বা স্পর্শ করে রোধ করা যাচ্ছে-যে পরিবর্তনটি ভিন্ন রকমের, স্বাভাবিক নয়। স্তন সম্পর্কে মনে উদ্বেগ হচ্ছে, যা পারিবারিক চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করতে হবে। স্তনে গুটি দেখা দিলে ১০টির মধ্যে নয়টিই ক্যান্সার নয়।
গুটি স্পর্শ করে কেমন অনুভূতি হবে
গুটি মনে হবে শক্ত, অসমান, আবার মসৃণও মনে হতে পারে। সন্দেহজনক গুটি সাধারণত শক্ত, অসম আকার। চারপাশের টিস্যু বা ত্বকে দৃঢ়ভাবে যুক্ত। তাই সহজে নড়ে না বা নড়ানো যায় না। নিরীহ গুটিকে মনে হবে আঙ্গুরের গুচ্ছের মতো-কিনারা মসৃণ, গোলাকার গুটি। তাই অস্বাভাবিক গুটি দেখা গেলে চিকিৎসক দিয়ে চেক করিয়ে নেওয়া উচিত।
স্তন নিজে নিজে চেক করে দেখা
স্তন নিজে পরীক্ষা করে জানতে হবে স্তন দেখতে কী রকম, ছুঁয়ে কেমন লাগে। এতে স্তনে কোনো অসুখ হলে আগাম শনাক্ত করা যায়।
নিউজিল্যান্ড স্তন ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের পরামর্শ, নারীকে ২০ বছর হওয়ার পর থেকে নিজের স্তন দুটো নিজে পরীক্ষা করে দেখা উচিত। চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে নিজের স্তন কীভাবে পরীক্ষা করা যায়। এ বিষয়ে সচিত্র পুস্তিকা ও ভিডিও আছে। যেসব নারী নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করেন, তারা জানতে পারেন স্বাভাবিক স্তন দেখতে কী রকম, ছুঁয়ে দেখলে কেমন লাগে, চাপ দিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করলেও কেমন লাগে। তাই দুর্ভাগ্যক্রমে জীবনকালে কোনো সময় যদি স্তন ক্যান্সার দেখাও যায়, তাহলে আগাম শনাক্ত হওয়ার সম্ভাবনা হয় অনেক বেশি। এমনও উদাহরণ আছে, স্তন-সচেতন অনেক নারী নিজেই গুটি শনাক্ত করেছেন, তখন হয়তো ম্যামোগ্রাম চিহ্নিত করতে পারেননি। তাই স্তন নিজে পরীক্ষার শ্রেষ্ঠ স্থান হলো-আয়নার সামনে ও স্মান করার সময়।
অগ্রাধিকার তিনঃ নিজের পারিবারিক চিকিৎসক
স্তন ক্যান্সার ফাউন্ডেশনের পরামর্শ হলো, আপনি যেকোনো বয়সের নারী হন, স্তন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ মনে এলে পারিবারিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট চেকআপ, অর্থাৎ চিকিৎসক দিয়ে স্তন পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া। ৪০ বছরের পর থেকে প্রতিবছর একবার করে করা উচিত।
পরিবারে যদি স্তন ক্যান্সার বা ডিম্বাশয়ে ক্যান্সারের ইতিহাস থাকে, তাহলে ব্যক্তিগত ঝুঁকি সম্পর্কে আলাপ করা উচিত চিকিৎসকের সঙ্গে। নারীর জীবনে ‘স্তন-সচেতনতা’ হওয়া উচিত জীবনযাপনের অঙ্গ।
— চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের প্রতিবছর একবার স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাম করা ভালো।
— যাঁদের স্তন ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে তাদের ৩০ বছর পর থেকেই বছরে স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাম, প্রয়োজনে এমআরআই করা উচিত।
— ২০-৩০ বছর যাঁর গড় ঝুঁকিও আছে, তাঁকে চিকিৎসক দিয়ে প্রতি তিন বছরে একবার করে স্তন পরীক্ষা করানো। এরপর বছরে একবার। স্তন স্পর্শ করে কেমন বোধ হয়, স্বাভাবিক স্তন কেমন-এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত।
— মাঝেমধ্যে নিজে স্তন পরীক্ষা করে দেখা উচিত। অসুবিধা মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
— ফল ও সবজিসমৃদ্ধ আহার।
— আদর্শ ওজন বজায় রাখা।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply