ওষুধ নিয়ে কথা
নিজে নিজেই ওষুধ খাচ্ছেন না তো!
নিজের ইচ্ছামতো, অনুমান করে, আত্মীয় বা পড়শির (যাঁরা চিকিৎসক নন) পরামর্শ কিংবা দোকানির দেওয়া ওষুধ খেলে জটিলতা দেখা দিতেই পারে। আমাদের দেশের অনেকে রোগনির্ণয়ের আগেই উপসর্গের শুরুতে ওষুধ সেবন করে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন ভাইরাসজনিত জ্বরে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট, সিরাপ বা সাসপেনশন মাত্রা অনুসারে খেলে জ্বর কমে যায়।
কিন্তু সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় ট্যাবলেট, সিরাপ বা কাশির সিরাপের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই, অর্থাৎ সর্দি-কাশি হলে এগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি কাজে আসে না। তবু সামান্য ভালোর জন্য অনেকেই টানা কয়েক দিন অ্যান্টিহিস্টামিন-জাতীয় ওষুধ সেবন করে থাকে, যা ঠিক নয়। আমাদের দেশের বর্তমান আইন অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড ও নেশাজাত-এ তিন ধরনের ওষুধ বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের নিবন্ধিত চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি করা নিষেধ। কিন্তু বাস্তবে সব ধরনের ওষুধই প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হচ্ছে। যে-কেউ ওষুধের দোকানে গিয়ে যেকোনো ওষুধই কিনতে পারে। নিজে নিজে ওষুধ ব্যবহার করে কিছু ক্ষেত্রে সাময়িক উপকার পাওয়া গেলেও অনেক ক্ষেত্রেই জটিলতা দেখা দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ ব্যবহারে বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় স্থায়ীভাবে শারীরিক ক্ষতি হতে পারে।
ওটিসি ওষুধ
পৃথিবীর সব দেশেই আইন অনুসারে কিছু ওষুধ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান থেকে কেনা যায়। এসব ওষুধ ওভার দ্য কাউন্টার বা ওটিসি হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাজ্যের মোট ওষুধের প্রায় এক- চতুর্থাংশ ওটিসি হলেও আমাদের দেশে সব ওষুধই ওটিসি অর্থাৎ ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কেনা যায়। অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধের অপব্যবহার বন্ধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসনের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। অসুখ হলেই সাধারণ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের রয়েছে। আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ও নানা রকম পরীক্ষার জন্য বেশ অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব এড়াতে অনেকেই স্বনির্বাচিত ওষুধ ব্যবহার করে থাকে। সরকারি চিকিৎসার সুযোগ কম থাকা ও অন্যান্য কারণে অনেকেই নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেয়ে থাকে।
স্বাস্থ্যনীতির যথাযথ ব্যবস্থার ঘাটতিও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধের ব্যবহার বাড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।
অ্যান্টিবায়োটিক
যেকোনো প্রদাহজনিত কারণ বা জীবাণু ধ্বংসের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে শিশুদের ক্ষেত্রে ন্যালিডাক্সিক এসিড, সিপ্রোফ্লক্সাসিলিন, কিশোর-বয়সীদের ক্ষেত্রে টেট্রাসাইক্লিন খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত। পেপটিক আলসারে অ্যাসপিরিন, কিডনির অসুবিধায় সালফার-জাতীয় ওষুধ ব্যবহার না করাই ভালো। একসঙ্গে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করা ও নির্ধারিত বিরতি অর্থাৎ ছয় বা আট ঘণ্টা পর অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে। ভরাপেটে অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন না, খাওয়ার আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টা পর খাওয়া অধিক কার্যকর। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া উচিত। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো কোর্সটি সম্পূর্ণ খাবেন। কিছুটা ভালো হওয়ার পর অ্যান্টিবায়োটিক বাদ দেবেন না, এতেও ওষুধটি পরে আর শরীরে কাজ করবে না। ওষুধ চলাকালে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন শরীরে লাল দাগ বা দানা, চুলকানি, চামড়ায় ফুস্কুড়ি দেখা দিলে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ওই ওষুধটির নাম মনে রাখবেন, যাতে পরে আপনি চিকিৎসককে বলতে পারেন।
স্টেরয়েডের ব্যবহার
হরমোন-জাতীয় ওষুধ স্টেরয়েড বেশ কিছু রোগে খুব দ্রুত কাজ করে বলে ওষুধের দোকানিরা এটা প্রায়ই দিয়ে থাকেন। অ্যাজমা বা হাঁপানি, শ্বাসকষ্টের অসুখসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগে স্টেরয়েড তাড়াতাড়ি উপশম এনে দিলেও শরীরের রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে, অন্য ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। স্টেরয়েডযুক্ত চোখের ড্রপ, ত্বকের মলমও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করবেন না।
ওষুধের সঠিক ব্যবহার
সর্দিজ্বর, গা ব্যথা হলে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট ও শিশুদের বয়স অনুযায়ী সাসপেনশন দেওয়া যেতে পারে। দু-তিন দিনে অবস্থার পরিবর্তন না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অ্যাসপিরিন, ডাইক্লোফেনাক খালিপেটে খাবেন না। অ্যান্টিহিস্টামিন, ভিটামিন, আয়রন অপ্রয়োজনে খাবেন না। পুড়ে গেলে মলম না লাগিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে জায়গাটি ধুয়ে পেট্রোলিয়াম জেলিযুক্ত গজ লাগাতে পারেন। জায়গাটি না ঢেকে বাতাস চলাচলের জন্য খোলা রাখুন। মচকে গেলে বা ব্যথা পেলে প্রথমে ঠান্ডা পানি দেবেন, পরে গরম সেঁক দিতে পারেন। ব্যথার মলম দেওয়ার দরকার নেই। ব্যথার জন্য ব্যথানাশক ইনজেকশন, শরীর দুর্বল লাগলে অযথা ভিটামিন-জাতীয় ইনজেকশন নেবেন না।
কয়েক দিন পর আবার যদি লাগে, এ কথা ভেবে শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক সিরাপ একবার তৈরির পর খাওয়া শেষে অবশিষ্ট অংশ সংরক্ষণ করবেন না। নাক দিয়ে পানি পড়লেই নাকের ড্রপ ব্যবহার করবেন না। গরমপানিতে সামান্য একটু মেনথল দিয়ে ভাপ নিলে উপকার পাবেন। গলা খুসখুস করলে অ্যান্টিহিস্টামিন না খেয়ে গরমপানির গড়গড়া করলে উপকার পাবেন। ওষুধ যথাসম্ভব বড় ফার্মেসি থেকে কিনবেন। বাসার সব ওষুধ শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন।
প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধগুলো-প্যারাসিটামল, জীবাণুনাশক বা অ্যান্টিসেপটিকের তরল বোতল, ওষুধযুক্ত প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যান্ড ইত্যাদি একটা নির্দিষ্ট স্থানে রাখুন, যেন প্রয়োজনের সময় সহজেই পাওয়া যায়।
ডা· রেজাউল ফরিদ খান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৪, ২০০৮
Leave a Reply