স্মার্ট। খুব পরিচিত একটি ইংরেজি শব্দ। অভিধানে স্মার্টের দুই রকম অর্থ রয়েছে। এক উজ্জ্বল, নবীন-দর্শন, কেতাদুরস্ত ইত্যাদি। দুই. তীব্র ব্যথা অনুভব করা বা তীব্র ব্যথা দেওয়া। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অর্থ। অথচ বানান একই। যাক, শব্দের অর্থ নিয়ে নিরর্থক প্যাঁচালে না গিয়ে বরং অর্থপূর্ণ বিষয়ে চলে আসি। মূল বিষয় ‘স্মার্টনেস’। বলা হয় বর্তমানে সকল সাফল্যের চাবিকাঠি এই স্মার্টনেস। সবাই বলেন বি স্মার্ট। কিন্তু এর সংজ্ঞা তো কেউ বলেন না। কারও কারও স্মার্টনেসে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়। আবার কারও স্মার্টনেসে সত্যিই, তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। কিন্তু আসলে স্মার্টনেস কী ? স্মার্টনেসের ব্যবচ্ছেদ করেছেন মোর্শেদ নাসের টিটু
১.
শুভ, অন্তু, শিমন পরস্পর খুবই কাছের বন্ধু। প্রতিদিন একবার দেখা হওয়া চাই-ই চাই। অন্যথায় নাওয়া খাওয়া হারাম। শুভ খুবই ক্যাজুয়াল, সবসময় সাদাসিধে পোশাক। কথাবার্তায় খুবই সাধারণ। তবে সবখানেই আছে পরিচ্ছন্ন উপস্থাপনা। অপরদিকে অন্তু হান্ড্রেড পার্সেন্ট ওয়েস্টার্ন। সারাক্ষণ কানে এমপিথ্রিতে লিংকিন পার্ক আর ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ। আর শিমন ? ও বোধহয় মেয়ে হলেই ভালো হতো। এত লজ্জাতো মেয়েদের বেলায়ও বেমানান। এই তিন বন্ধু যেখানেই যাক শুভ যখন কথা বলে তখন সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। ক্লাসে বা আড্ডায় সবখানেই শুভ মধ্যমনি। শিমনের লজ্জাবতীর ন্যায় লাজুক মুখাবয়ব বা অন্তুর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর স্পাইক চুল কখনোই শুভর সহজ সাবলীল উপস্থাপনাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। কারণ শুভ তার ব্যবহারে, চলনে, বলনে সবসময়ই নিজেকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নভাবে উপস্থাপন করে।
২.
শিক্ষিত এবং রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে নিগার। বয়স ১৭। ইদানীং সে বেশ ফ্যাশন সচেতন হয়ে পড়েছে। অবশ্য ফ্যাশন সচেতন না বলে একে ফ্যাশনের প্রতি দূর্বলতা বলা যেতে পারে। কারণ ফ্যাশন করতে গিয়ে নিগার তার পরিবারের সীমানা পেরিয়ে গেছে। বাবা মায়ের আপত্তি উপেক্ষা করে টাইট জিন্স, টি শার্ট, মিনিস্কার্ট পরা শুরু করেছে। যা নিগারের জন্য যারপরনাই বেমানান। কিন্তু নিগার স্মার্টনেস প্রদর্শনের জন্য বেছে নিয়েছে এসব। অথচ সে জানে না সবাই তার পেছনে তাকে বিকৃত রুচির মেয়ে, ওভারস্মার্ট বলে সম্বোধন করে।
৩.
একদিন মিউজিক ওরিয়েন্টেড কয়েকজন তরুণ আড্ডা দিচ্ছে। সবাই মিউজিক পছন্দ করে। তবে একেকজন একেকরকম। যেমন জয়, শাহেদ, সঞ্জীবের পছন্দ ওয়েস্টার্ন, রক। কিন্তু ওদের আরেক বন্ধু রোহান পছন্দ করে রবীন্দ্র সংগীত আর নজরুল। আড্ডার সবাই জয়, শাহেদ, সঞ্জীবের কাছে রক মিউজিকের গবেষনা শুনছে। এক পর্যায়ে রোহান যখনই বললো আমার প্রিয় গান ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল্ব তখন সবার যেনো হাসি ধরে না। ক্ষেত, আনস্মার্টের মতো কটুক্তিও শুনতে হলো তাকে। রোহান ভাবলো ইংরেজি ধুম-ধাড়াক্কা গান আমার ভালো লাগে না, শুনি না। রবীন্দ্র, নজরুল ভালো লাগে শুনি। কিন্তু গানের পছন্দের সাথে স্মার্টনেসের কী সম্পর্ক ? গান তো গানই।
৪.
সিমি ও নোভেনা দুই বান্ধবী। নোভেনা সাদাসিধে আর সিমি ড্যাম কেয়ার প্রকৃতির। ঋতু বদলের মতো বয়ফ্রেন্ডের পালা বদল হয় সিমির। স্মার্টনেসের বহিঃর্প্রকাশ ঘটাতে হাতে তুলে নেয় সিগারেট। এক পর্যায়ে নেশায় আসক্ত হয়। নোভেনা বাধা দিলে সিমি বলে চুপ থাক বাঙাল। তুই স্মার্টনেসের কি বুঝিস।
পোশাক
পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে হতে হবে যথেষ্ট রুচিবান। চলতি হাল ফ্যাশনে গা ভাসিয়ে পোশাক পরা স্মার্টনেস নয় বরং আপনাকে যে পোশাকটি পরলে সুন্দর লাগবে সেটাই আপনার জন্য মানানসই। আর টিভি, ফিল্মের হিরো-হিরোইনদের ফলো না করে নিজস্ব সমাজ-সংস্কৃতি বিবেচনায় এনে নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এতে আপনার স্বকীয়তা ফুটে উঠবে। যা স্মার্টনেসের অন্যতম শর্ত। একই সাথে কোথায় কোন পোশাক পরে যাবেন সেটিও খেয়াল রাখা উচিত। যেমন ক্লাব পার্টিতে আপনি জিন্স, টি-শার্ট, ব্রেসলেট পরতে পারেন কিন্তু অফিসে নিশ্চয়ই এভাবে যাওয়া সমীচিন হবে না। মেয়েদের বেলায় পরিমিত অলংকার শিথিলযোগ্য। তবে কখনোই তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। পোশাকের রংয়ের ব্যাপারেও খেয়াল রাখা জরুরি।
ব্যবহার
ব্যবহারে বংশের পরিচয়। অবশ্য এখন বংশের পরিচয় না খুঁজলেও স্মার্টনেসের গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হলো ব্যবহার। বিনয়ী, ভদ্র আচরণই স্মার্টনেসের লক্ষণ। মানুষের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়, হ্যান্ডশেক ইত্যাদি স্মার্টনেসের প্রকাশ ঘটায়। ন্যাকামি বা আহ্লাদিপনা সর্বাঙ্গে বর্জনীয়। কথপোকথনের সময় বাচনভঙ্গি থাকতে হবে স্মার্ট এবং কণ্ঠস্বর থাকবে দৃঢ়। তবেই না বোঝা যাবে স্মার্ট। আর অবশ্যই যে কোন ধরনের মুদ্রাদোষ পরিহার করতে হবে। যেমন মাথা চুলকানো, অঙ্গভঙ্গি করা, মুখ দিয়ে শব্দ করা ইত্যাদি। মানুষকে অবমূল্যায়ন করবেন না। অথবা সর্বদা নিজেকে বড় ভাববেন না। আবার নিজেকে ছোটও ভাববেন না যেন। অর্থাৎ সবার সঠিক মূল্যালয়নই একজন স্মার্ট ব্যক্তির কাছ থেকে সবার কাম্য।
জ্ঞানদান বর্জনীয়
যতটুকু জানেন ততটুকুই প্রকাশ করুন। নিজেকে জাহির করার জন্য অতিরিক্ত বলবেন না। বলা তো যায় না হিতে বিপরীতও হতে পারে না। আপনি যা তাই প্রকাশ করবেন। যেখানে সেখানে জ্ঞানদান করতে গেলে আপনার কপালে বাঁচাল অ্যাওয়ার্ডটি জুটে যেতে পারে। আর যদি মাত্রা বেশি হয় তবে আঁতেল থেকে আঁতেলেকচুয়ালও বনে যেতে পারেন। তাই সাধু সাবধান।
আরো কিছু বিষয়
০ ধরা যাক আপনি খুব সুন্দর মানানসই পোশাক পরেছেন। কথাবার্তায় স্টাইলও ভালো। কিন্তু শরীর থেকে ঘামের বিদঘুটে গন্ধ বেরুচ্ছে। কেউতো আপনার কাছেই আসবে না। তাহলে আপনার পোশাক আর ব্যক্তিত্বপূর্ণ ব্যবহার হয়ে পড়বে অর্থহীন। এক্ষেত্রে পারফিউমই হতে পারে আপনার কাছের বন্ধু।
০ একজন স্মার্ট মানুষের বন্ধুতেও হতে হবে স্মার্ট। তাই বন্ধু নির্বাচনেও খেয়াল রাখতে হবে। সে আপনার সাথে চলতে পারবে কিনা ? তার মানবিতা আপনার সাথে মেলে কিনা ? এসব কিছু দেখেই বন্ধু নির্বাচন করা উচিত। কারণ বন্ধুত্ব হচ্ছে মনের মিলন।
০ অন্যকে স্মার্ট ভেবে নিজেকে ক্ষেত ভাবা উচিত নয় কখনোই। এতে করে হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। সবসময় সুন্দর আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তই নন। আত্মসম্মান বজায় রেখে চলুন।
০ একজনকে নিজের আইডল হিসেবে বেছে নিন। তার মতাদর্শে গড়ে তুলুন নিজেকে। এক্ষেত্রে বাবা-মাই হতে পারে সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
০ কখনো নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে বড়দের সাথে আলোচনা করে ফেলা উচিত। নিজেকে কখনো কোনো বিষয়েই সিদ্ধান্তহীনতায় রাখবেন না। এতে আপনি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। তাই যে কোন সমস্যায় বাবা মা অথবা বড়ো কারো সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করুন।
০ এই ফিচারটি থেকে বোধকরি আপনারা স্মার্টনেস সম্পর্কে একটি উপরিতল ধারণা অর্থাৎ সারফেস আইডিয়া পেয়েছেন। আপনাকে যদি সামান্যতম উপকার সাধন করতে পারি সেটাই হবে এই স্মার্ট প্রতিবেদনের স্মার্ট সাকসেস।
মডেল নওশীন ও তৃষা
ছবি তুলেছেন আশীষ সেনগুপ্ত
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, অক্টোবর ১৩, ২০০৯
Leave a Reply