প্রতিবছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার সারা বিশ্বে দৃষ্টি দিবস পালন করা হয়। আগামীকাল ৯ অক্টোবর বিশ্ব দৃষ্টি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে বয়স্কদের দৃষ্টি। ছানি বার্ধক্যের চক্ষুরোগ। ২০০৯ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জ জেলাকে ছানিমুক্ত করার লক্ষ্যে উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতাল অরবিস ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ একটি চাহিদাভিত্তিক চক্ষুসেবা প্রকল্প পরিচালনা করছে। বিশ্ব দৃষ্টি দিবস উপলক্ষে এ নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন।
সারা বিশ্বে যখন বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক সেই সময় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিত্ব মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তার করছে বয়স্ক ব্যক্তি, তাদের পরিবার ও সমাজের ওপর। সারা বিশ্বে অন্ধ ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৪৫ মিলিয়ন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ অন্ধ ব্যক্তির বয়স ৫০ অথবা তার ঊর্ধ্বে। সুস্থ দৃষ্টিসম্পন্ন বয়স্ক ব্যক্তি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে কর্মক্ষম থাকতে পারে এবং তারা সমাজের কল্যাণ সাধনে প্রয়োজনীয় ভূমিকাও রাখতে সক্ষম। স্বল্পদৃষ্টি, ছানি, ডায়াবেটিসজনিত দৃষ্টি সমস্যা (ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি) এবং চোখের রেটিনার মধ্যভাগে সমস্যা (ম্যাকুলার ডিজেনারেশন) ইত্যাদি বয়স্ক লোকদের দৃষ্টি সমস্যার প্রধান কারণ।
বাংলাদেশে চোখের ছানি রোগ
বাংলাদেশে সাত লাখ ৫০ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক লোক অন্ধত্বের শিকার এবং বাংলাদেশে অন্ধত্বের মূল কারণ ছানি। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ লোকই ছানিজনিত কারণে অন্ধ। বর্তমানে বাংলাদেশে ছানিপড়া লোকের সংখ্যা পাঁচ লাখ ৫০ হাজার। এ ছাড়া প্রতিবছর আরও এক লাখ ১০ হাজার লোক নতুনভাবে ছানিপড়া রোগে আক্রান্ত হয়। এ বিপুলসংখ্যক ছানিপড়া রোগের চিকিৎসার জন্য অরবিস ইন্টারন্যাশনাল নানা ধরনের কৌশলের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে সুলভে এবং সহজে চক্ষুসেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
মানিকগঞ্জে অরবিসের প্রকল্প
অরবিস একটি অলাভজনক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। অরবিস বাংলাদেশে ছানিপড়া রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য মানিকগঞ্জে একটি ‘চাহিদাভিত্তিক চক্ষুসেবা অর্থায়ন প্রকল্প’ পরিচালনা করছে। এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো ২০০৯ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জকে ছানিমুক্ত করা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে পরিচালিত একটি প্রাক-সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানিকগঞ্জে ১ দশমিক ৪ মিলিয়ন লোক বাস করে এবং এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১ দশমিক ৬৪ শতাংশ অন্ধ লোকের বয়সসীমাই ৫০-এর ঊর্ধ্বে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ লোকের অন্ধত্বের মূল কারণ ছানি। উল্লেখ্য, পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে ছানিপড়া রোগীর সংখ্যা বেশি। কারণ, এ অঞ্চলে পুরুষদের চক্ষুসেবা নেওয়ার হার নারীদের তুলনায় বেশি। মানিকগঞ্জে চোখের সেবা দেওয়ার জন্য তিনটি হাসপাতাল রয়েছে-১· মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতাল, ২· দ্বীপ জ্বেলে যাই হাসপাতাল ও ৩· মমতাজ চক্ষু হাসপাতাল। তিনটি হাসপাতালেই রয়েছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব, যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা এবং দক্ষ জনবলসহ প্রয়োজনীয় সহায়ক উপকরণের ঘাটতি। মানিকগঞ্জ জেলাকে ২০০৯ সালের মধ্যে ছানিমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে অরবিস একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে চক্ষুসেবা রসিদ বিতরণের মাধ্যমে।
বাড়ি বাড়ি রোগী খোঁজা
এ প্রকল্পের শুরুতেই স্থানীয় সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের ছানি রোগ চিহ্নিতকরণ ও চিহ্নিত রোগীদের হাসপাতালে প্রেরণের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এরপর প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন করে ছানিপড়া রোগীদের চিহ্নিত করে হাসপাতালে গিয়ে সেবা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। স্থানীয় হাসপাতালে গিয়ে চিহ্নিত রোগীরা যাতে সহজে তাদের পরিচয় দিতে পারে সে জন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রত্যেক ছানিপড়া রোগীকে একটি করে চক্ষুসেবা রসিদ দিয়ে থাকে। পরবর্তীকালে ছানিপড়া রোগীরা যখনই এ রসিদটিসহ উল্লিখিত তিনটি হাসপাতালের একটিতে যায়, তখনই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে তাদের চোখের ছানি অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার করা হয়।
নারীদের ছানি রোগ চিকিৎসা
রোগীদের কাছে প্রয়োজনীয় সেবা সহায়তার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে অরবিস স্থানীয় তিনটি হাসপাতালে অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সরবরাহ এবং দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য চিকিৎসক, সেবিকা, প্যারামেডিক্স, কাউন্সিলরদের প্রশিক্ষণসহ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির মান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছে। এতে এলাকার যেসব নারী চোখের সেবা নেওয়ার জন্য আগে হাসপাতালে যেত না, চক্ষুসেবা রসিদ গ্রহণের পর তারা নিয়মিতভাবে হাসপাতালে গিয়ে সেবা নিচ্ছে।
সম্প্রতি পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, দেড় বছরে মানিকগঞ্জে ছানিপড়া সাড়ে তিন হাজার দরিদ্র রোগী অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে। জরিপে আরও দেখা গেছে, এ প্রকল্প শুরুর পর স্থানীয় পর্যায়ের দরিদ্র মানুষ ছানিপড়া রোগীর অস্ত্রোপচারের পরিমাণ আগের তুলনায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব ছানিপড়া রোগী অস্ত্রোপচার করেছে, তাদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ নারী ও ৪৬ শতাংশ পুরুষ।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি
ছানিপড়া রোগের পাশাপাশি বয়স্কদের অন্ধত্বের আরেকটি প্রধান কারণ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। বাংলাদেশে পাঁচ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক লোক ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ পাঁচ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর প্রতি পাঁচজনে একজনই ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নামের চোখের রোগে আক্রান্ত। এটিও একটি মারাত্মক রোগ, যাতে ডায়াবেটিস রোগীর চোখের রক্তনালিগুলো থেকে ধীরে ধীরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং রক্ত জমাট বেঁধে হঠাৎই সম্পূর্ণরূপে অন্ধ হয়ে যায়। তাই বিপুলসংখ্যক ডায়াবেটিস রোগীকে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য অরবিস ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে তিনটি জেলায়-১· দিনাজপুর, ২· ঠাকুরগাঁও, ৩· বগুড়ায় লেজার ট্রিটমেন্টসহ উন্নত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে।
ডা· আবু রায়হান
কান্ট্রি ডিরেক্টর
অরবিস ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ
অনুলিখনঃ তাসকিনা হক
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৮, ২০০৮
Leave a Reply