১৫ লাখ মানুষের জন্য একজন মনোচিকিৎসক!
‘মানসিক স্বাস্থ্য’ বিষয়টি এড়িয়ে চলা বা গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে রয়েছে; তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে হয়তো এটা খানিক বেশি। বাংলাদেশে মানসিক রোগবিষয়ক জনসচেতনতা এবং এ রোগের হার নির্ণয় করার জন্য ২০০৩-২০০৫ পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় একটি জাতীয় পর্যায়ের জরিপ চালানো হয়।
সেখানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৮ বছরের ওপরের জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ মৃদু থেকে গুরুতর মানসিক সমস্যায় ভুগছে। আর ২০০৭ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতি লাখে ০·৪৯ জন করে (অর্থাৎ প্রায় দুই লাখ মানুষের জন্য মাত্র একজন করে) মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে-এই মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী বলতে বোঝাচ্ছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনশ্চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, সাইকোলজিস্ট, নার্স, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার, অকুপেশনাল থেরাপিস্টসহ অন্যরা। আবার প্রতি এক লাখ জনগোষ্ঠীর জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছে মাত্র ০·০৭৩ জন, অর্থাৎ প্রায় ১৫ লাখ মানুষের জন্য গড়ে একজনেরও কম। সাইকোলজিস্টসহ অন্যদের সংখ্যাও অত্যন্ত অপ্রতুল।
সারা দেশে বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে যতগুলো মনোরোগশয্যা রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রতি লাখ মানুষের জন্য ০·৫৮টি করে শয্যা আছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, প্রতি এক লাখ ৭২ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে একটি মনোরোগশয্যা! ২০০৫ সালে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রদান করা হয়েছিল মানসিক স্বাস্থ্য খাতে। অথচ মোট জনসংখ্যার ১৬ দশমিক ৫ শতাংশের কমবেশি মানসিক সহায়তা প্রয়োজন।
মানসিক রোগ নিয়ে আমাদের সমাজে রয়েছে নানা ভুল ধারণা। এ সুযোগে জায়গা করে নিয়েছে নানা অপচিকিৎসা। প্রাধান্য দেওয়া দূরের কথা, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আমাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের কাছে রীতিমতো উপেক্ষিত।
বর্তমানে প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতির খসড়ার বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি ও রোগ নিরাময়ের কথা খুবই সামান্য আকারে উত্থাপন করা হয়েছে, যেখানে দেশের ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া প্রয়োজন।
আবার এ খাতে জনবল ও সম্পদের অপ্রতুলতা এত বেশি যে এখানে প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যনীতিতে মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
শরীরের যেকোনো ছোট-বড় অসুখে আমরা যত উতলা হই, মানসিক সমস্যাকে তত গুরুত্ব দিই না। আবার অনেক সময় কোনটি যে মানসিক সমস্যা, সেটি বোঝাও আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ ধরনের উপেক্ষা আর অবজ্ঞার ফলে মৃদু মানসিক রোগ পরিণত হয় গুরুতর মানসিক রোগে এবং যে মানসিক সমস্যাকে প্রতিরোধ করা যেত, তাকে প্রতিরোধ করতে পারি না।
কেবল সাধারণ মানুষ নয়, বরং চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যেও রয়েছে মানসিক রোগ নিয়ে অসচেতনতা, এর মূল কারণ, একজন চিকিৎসক সমাজেরই একজন, তাই সামাজিক অসচেতনতা তাঁকেও অনেকাংশে স্পর্শ করে, প্রভাবিত করে; পাশাপাশি চিকিৎসাশিক্ষার স্মাতক পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের অংশটুকু অতীতে গুরুত্বের সঙ্গে সন্নিবেশিত ছিল না এবং বর্তমানে যেটুকু আছে তাও যথেষ্ট নয়।
তাই দেখা যায়, জেনে না জেনে অনেক চিকিৎসকই মানসিক সমস্যা উপেক্ষা করে কেবল শারীরিক রোগের চিকিৎসা করছেন, কখনো সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও মানসিক রোগের ওষুধ প্রদান করছেন, যা সব সময় যথাযথ হচ্ছে না, এমনকি বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতাল বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে রোগীকে রীতিমতো অনুৎসাহিত করছেন। এ বিষয়গুলো আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য হয়ে উঠছে আত্মঘাতী।
বিষয়গুলো বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশে প্রায় একই রকম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ১৯২টি সদস্যরাষ্ট্র ও ১১টি সহযোগী-সদস্যরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর এক বিশ্বব্যাপী জরিপ চালিয়ে দেখতে পায়, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশেই মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপযুক্ত নীতি ও আইন নেই। আর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ৫০ শতাংশ দেশে নেই এ-সংক্রান্ত নীতিমালা। আর যেসব দেশে রয়েছে তার বেশির ভাগই ষাটের দশকের করা আইন, যেগুলো সময়োপযোগী হালনাগাদ করা হয়নি।
বাংলাদেশে ১৫ লাখ মানুষের জন্য গড়ে একজন বা তারও কম মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন এবং মোট বিশেষজ্ঞের মধ্যে অধিকাংশই রয়েছেন শহরাঞ্চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ৪১ শতাংশ দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে মানসিক স্বাস্থ্য স্থান পায়নি। বলা বাহুল্য, এই ৪১ শতাংশের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোর সংখ্যাই বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ গবেষণায় দেখা যায়, ৩০ শতাংশ রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য-বাজেটে মানসিক স্বাস্থ্যের কোনো স্থান নেই, ২৫ শতাংশ রাষ্ট্র তাদের স্বাস্থ্য-বাজেটের মাত্র এক শতাংশ খরচ করে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে।
চিকিৎসা-সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উন্নত দেশে ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ এবং অনুন্নত দেশে ৭৬ থেকে ৮৫ শতাংশ গুরুতর মানসিক রোগী তাদের রোগ-লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার ১২ মাসের মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা গ্রহণ করে না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে মানসিক স্বাস্থ্যকে আনুপাতিক গুরুত্ব দেওয়া এবং প্রয়োজনে আলাদা মানসিক স্বাস্থ্যনীতি তৈরি করা দরকার।
এ ছাড়া বাংলাদেশে যে অল্পসংখ্যক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তার ঘাটতি মোকাবিলায় আরও দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং পাশাপাশি বিদ্যমান জনশক্তির মানোন্নয়নে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও বেশি মানসিক রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।
এসব বিষয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজন জনসম্পৃক্ততা এবং কার্যকর পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা একটি গণমুখী সেবা খাত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। জনগণের দোরগোড়ায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে প্রয়োজন ‘কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ সার্ভিস’, যার অর্থ হচ্ছে কেবল হাসপাতালে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নয়, বরং এই সেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে ন্যূনতম মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো তৈরি করা।
বাংলাদেশে বর্তমানে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা মানসিক হাসপাতাল ও সরকারি মেডিকেল কলেজসমূহে মানসিক রোগ বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি কয়েকটি মেডিকেল কলেজের মতো কিছু প্রতিষ্ঠানেও এ সেবা দেওয়া হয়।
আবার দেশের ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ মানসিক রোগীর একটি বিরাট অংশ এ সেবা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়, অথবা সামাজিক সংস্কারের কারণে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা নিতে আগ্রহী নয়। আর যে অংশটি চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য আগ্রহী, তাদের জন্যও বর্তমান কাঠামোতে জনবল ও সম্পদের পরিমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল।
দেখা যাচ্ছে, এ বছরের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের যে প্রতিপাদ্য বিষয়, তার বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের প্রথমত মানসিক রোগ বিষয়ে জনগণের মধ্যে বিদ্যমান অজ্ঞতা দূর করতে হবে, প্রয়োজনীয় সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং মানসিক রোগের যে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা আছে, সে বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিদ্যমান অবকাঠামোর পরিমাণগত ও গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য যথাযথ রাষ্ট্রীয় বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে, সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে আর দক্ষ জনবল ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। এসব কিছুর জন্য অবধারিতভাবে জনগণের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা আর কার্যকর অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
ডা· আহমেদ হেলাল
সহকারী রেজিস্ট্রার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৮, ২০০৮
Leave a Reply