গত ২৮ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। জলাতঙ্ক রোগটি খুবই ভয়াবহ। কুকুর, বিড়াল ও অন্য পশুর কামড় বা আঁচড় থেকে এ রোগ হয়। ১৮৮৫ সালে লুই পাস্তুর এ রোগের টিকা আবিষ্কার করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম। প্রতিবছর জলাতঙ্ক রোগে বিশ্বে ৫৫ হাজার মানুষ মারা যায়, যার বেশির ভাগই শিশু। জলাতঙ্ক হয় রেবিস ভাইরাসের মাধ্যমে। এ ভাইরাস মস্তিষ্কের স্টেমের নিউক্লিয়াস এমবিগুয়সে আক্রমণ করে। মস্তিষ্কের এ অংশটি প্রশ্বাসে নিয়োজিত শরীরের বিভিন্ন অংশকে অতিরিক্ত উত্তেজনা থেকে দমন করে রাখে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সমন্বয় ঘটায়। কিন্তু ভাইরাস সংক্রমণে এই কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ফলে জলাতঙ্ক রোগী যখন পানি খেতে যায়, তখন তার গলা ও শ্বাসনালি উত্তেজনায় সংকুচিত হয়ে তীব্র ব্যথার অনুভূতি জাগায়। সেই সঙ্গে কিছু পানি শ্বাসনালি দিয়ে মূল শ্বসনতন্ত্রে ঢুকে অনবরত কাশি হয়ে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফলে পানি দেখলেই এসব রোগী ভয় পায়। তাই এ রোগের নাম জলাতঙ্ক। উল্লিখিত লক্ষণ ছাড়াও এ রোগে অসংলগ্ন আচরণ, আবোলতাবোল কথাবার্তা, দৈনন্দিন কাজ করতে না পারা, অতিরিক্ত উত্তেজনা, শ্বাসকষ্ট এমনকি শ্বসনতন্ত্র অকেজোও হয়ে যেতে পারে। একবার এ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে, যা মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। তাই এ রোগ প্রতিরোধে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
কী করবেন
* যেসব প্রাণীর আঁচড় বা কামড়ে জলাতঙ্ক হয়, যেমন-কুকুর, বিড়াল, শেয়াল প্রভৃতি থেকে সাবধান থাকা এবং তাদের সংস্পর্শে না আসা। বিশেষ করে বাচ্চাদের দূরে রাখা।
* গৃহপালিত কুকুর-বিড়ালকে নিয়মিত টিকা দেওয়া।
* রাস্তায় বেওয়ারিশ ও টিকা না দেওয়া কুকুর-বিড়াল মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা।
* কুকুরে না কামড়ালেও আগে থেকে টিকা দেওয়া যায়। ০, ৭, ২১ অথবা ২৮তম দিনে তিন থেকে চারটি টিকা দিতে হবে। টিকা দেওয়ার প্রথম দিনকে ‘০’ ধরতে হবে। সবাই এ টিকা নিতে পারে।
* কুকুর কামড়ালে ক্ষতস্থান সাবান পানি দিয়ে অন্তত ১০ মিনিট ধরে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। এরপর দিতে হবে পভিডন আয়োডিন। ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ, কাপড় বা অন্য কিছু দিয়ে কখনো ঢাকা যাবে না।
* জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে এমন কুকুর বা অন্য পশু কামড় বা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে টিকা নেওয়া উচিত। ০, ৩, ৭, ১৪ ও ২৮তম দিনে টিকা দিতে হয়। আগে বলা হতো, কোনো কুকুর কামড়ালে সেই কুকুরকে ১০ দিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ১০ দিনের মধ্যে কুকুরটি মারা না গেলে টিকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু এখন সে ধারণা সত্য নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে ৫০০ জন জলাতঙ্ক রোগীর মধ্যে গবেষণা করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ৭৫ জনের ক্ষেত্রেই দায়ী কুকুরগুলো দীর্ঘদিন জীবিত ছিল। তা ছাড়া সম্পূর্ণ সুস্থ কুকুরও জলাতঙ্কের জীবাণু বয়ে বেড়াতে পারে। বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সম্পূর্ণ সুস্থ পাঁচটি কুকুর মেরে সেগুলোর মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখেছেন, প্রতিটির মধ্যে ‘নেগরি-বডি’ রয়েছে, যা ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করে। সুতরাং বাইরে থেকে আপাত সুস্থ দেখতে কুকুরের মধ্যেও জলাতঙ্কের জীবাণু থাকতে পারে। তাই কুকুরে কামড়ালে দেরি না করে টিকা নেওয়া উচিত। সঙ্গে দিতে হবে ইমিউনোগ্লোবিওলিন ইনজেকশন।
এই ইমিউনোগ্লোবিওলিন ইনজেকশন অবশ্য বেশ ব্যয়বহুল ও অপ্রতুল। জলাতঙ্কের টিকার দাম অনেক, সরবরাহও কম। উপজেলা পর্যায়ে তো নেই বললেই চলে। তাই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ জলাতঙ্কের টিকা নিতে পারে। অনেকে আবার সামর্থ্য থাকলেও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চায় না, ঘরে বসেই কলাপড়া, পানিপড়া কিংবা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসা করায়। এতে গ্রামগঞ্জের এক বিশাল জনগোষ্ঠী অগোচরেই এ রোগে মারা যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকার, বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক সংগঠনসহ সবারই এগিয়ে আসতে হবে। সবাইকে হতে হবে আরও সচেতন।
ডা· আবু সাঈদ শিমুল
চিকিৎসা কর্মকর্তা
পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, চট্টগ্রাম
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৮, ২০০৮
Leave a Reply