করোনার টিকা গ্রহণের পর মোটামুটি ভালো সুরক্ষা পাওয়া যায়, এটাই সাধারণভাবে আমরা জেনে এসেছি। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে টিকা গ্রহণের পরও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এমনকি দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন কেউ কেউ। একে বলা হচ্ছে ‘ব্রেক থ্রু’। অর্থাৎ যেটা হওয়ার কথা নয়, সেটাই ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা খুব কম, কিন্তু মানুষের মনে টিকার প্রতি আস্থা কিছুটা ধাক্কা খাচ্ছে।
‘দক্ষিণ আফ্রিকার রূপান্তরিত ভাইরাস’, ‘দুবার রূপান্তরিত ভাইরাস’, ‘টিকায় আটকায় না—এমন ভাইরাস’ বা জাপানের ‘ইইকে’ ভাইরাসের কথা বেশি আলোচিত হচ্ছে। মানুষ চিন্তিত।
অথচ ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার টিকা নেওয়া দরকার, না হলে করোনা দূর করা যাবে না। বিশ্বের প্রতিটি দেশের অন্তত ৭০–৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে না পারলে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হবে না।
এখানেই মানুষের মনে একটা প্রশ্ন। টিকা নেওয়ার পরও যদি করোনায় আক্রান্ত হতে হয়, তাহলে সুরক্ষার আশা করা যায় কি? এ বিষয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১৫ এপ্রিল ২০২১, তারা পারকার পোপ একটি বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, এটা ঠিক যে বিভিন্ন রূপান্তরিত ভাইরাস দ্রুত ছড়ায় বা তীব্র সংক্রমণ ঘটায়। কিন্তু যাঁদের টিকা নেওয়া হয়নি, তাঁদের জন্য এই ভাইরাস বেশি ভয়ের। কারণ, তাঁদের দেহে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি থাকে না। ফলে সহজেই আক্রান্ত হন। ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলায় স্ক্রিপস রিসার্চের মলিকিউলার মেডিসিনের অধ্যাপক ড. এরিক টোপোল বলেছেন, দ্বিতীয়বার টিকা গ্রহণের দুই সপ্তাহ পর করোনার কোনো রূপান্তরিত ভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
এটা ঠিক, দক্ষিণ আফ্রিকার রূপান্তরিত ভাইরাস বা অন্যান্য রূপান্তরিত ভাইরাস জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বাড়তি হুমকি। আবার এটাও ঠিক যে কোনো টিকাই পূর্ণ সুরক্ষা দেয় না। করোনার টিকাও বিভিন্ন মাত্রায় সুরক্ষা দেয়, পূর্ণ মাত্রায় নয়। তাই টিকা নেওয়ার পরও কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে তাঁদের সংখ্যা কম এবং সংক্রমণের তীব্রতাও কম থাকে। এটা টিকার একটা সুফল বলা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট ড. অ্যান্থনি এস ফাউসি বলেন, বিভিন্ন রূপান্তরিত ভাইরাসের কারণেই টিকা নেওয়ার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। করোনার টিকা বিভিন্ন রূপান্তরিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভালোই কাজ করছে এবং কয়েকটি রূপান্তরিত ভাইরাসের সংক্রমণের তীব্রতা কমিয়ে দিচ্ছে। আপনার চারপাশে সবার যদি টিকা নেওয়া থাকে, তাহলে ভাইরাসের রূপান্তর নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকে না।
বিশ্বের প্রথম সারির ভাইরোলজিস্টরা যদি এত জোর দিয়ে এ কথা বলেন, তাহলে আমরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত হতে পারি। তবে মনে রাখতে হবে, টিকাই শেষ কথা নয়। এর পরও বহু দিন, অন্তত দেশের এবং বিশ্বের জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ টিকা গ্রহণ না করা পর্যন্ত সবার স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। আমরা অনেকেই এদিকে গুরুত্ব দিই না। এর ফল ভয়াবহ হতে পারে। দিন দিন যে দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে, এর কারণ আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতা।
জনসন অ্যান্ড জনসন টিকায় সমস্যা
জনসন অ্যান্ড জনসন টিকায় কিছু বিরূপ উপসর্গের সংবাদে আপাতত এই টিকা দেওয়া স্থগিত রাখা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত ৭০ লাখের বেশি মানুষ এই টিকা নিয়েছেন। টিকা নেওয়ার এক থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ছয়জন অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য সংস্থা জনসন অ্যান্ড জনসন টিকা আপাতত স্থগিত রাখার কথা বলে। এই টিকা গ্রহণের কিছুদিন পর আলোচ্য কয়েকজনের রক্ত জমাট বেঁধে গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়। রক্ত জমাট বাঁধার বিষয়টি নিয়ে গবেষকেরা অনুসন্ধান করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ জানিয়েছে, পূর্ববর্তী তিন সপ্তাহের মধ্যে এই টিকা গ্রহণকারীদের কারও যদি প্রচণ্ড মাথাব্যথা, কোমরে ব্যথা, পায়ে ব্যথা বা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তাহলে যেন সঙ্গে সঙ্গে তাদের জানায়। জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকায় সৃষ্ট উপসর্গ সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার একটা সুবিধা হলো এর দুই ডোজের প্রয়োজন হয় না, এক ডোজেই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পাওয়া যায়। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ আশা করছে, প্রয়োজনীয় বিচার–বিশ্লেষণের পর এই টিকা প্রয়োগের বিষয়ে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে।
কঠোর লকডাউন
প্রথমে কয়েক দিনের কিছুটা ঢিলেঢালা লকডাউন দেওয়া হয়। পরে আট দিনের কঠোর লকডাউন। লকডাউন সবার মেনে চলা দরকার। কারণ, করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় লকডাউন কঠোরভাবে মেনে চললে হয়তো করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।
তবে লকডাউন একটানা বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে আমরা যদি অন্তত তিনটি নিয়ম সবাই মেনে চলি, তাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। প্রথম কাজ হলো বাসার বাইরে চলাফেরা, কেনাকাটা বা অফিসে কাজের সময় মুখে মাস্ক পরা। মাস্ক যেন নাক–মুখ পুরোপুরি ঢেকে রাখে, তা নিশ্চিত করা। সবাই যদি ঘরের বাইরে মাস্ক পরেন, তাহলে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ভিড় এড়িয়ে চলা, তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা। এবং তৃতীয়ত, কিছু সময় পরপর সাবান–পানিতে হাত ধোয়া। এ তিনটি নিয়ম আমাদের বহুদিন মেনে চলতে হবে। তাহলে হয়তো আমরা করোনা নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং একই সঙ্গে দেশের সবাইকে টিকার আওতায় এনে করোনা সংক্রমণ রোধ করতে পারব।
আব্দুল কাইয়ুম, মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
স্বাস্থ্য | DesheBideshe
2021-04-18 05:53:44
Source link
Leave a Reply