কেস স্টাডি-১
মিসেস আসমা আখতারের বয়স ৪০। তিনি যখন প্রথম অ্যারিদমিয়া (অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন) নিয়ে ক্লিনিকে আসেন, তখন তাঁর সমস্যা ছিল হঠাৎ বুক ধড়ফড়ের সঙ্গে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, অত্যধিক দুর্বলতা ইত্যাদি। তাঁর আগের সব কাগজপত্র এবং ওই মুহূর্তের ইসিজি পরীক্ষা করে দেখা গেল, সমস্যাটি সুপরাভেনট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া (এসভিটি), যা হৃৎপিণ্ডের অত্যন্ত সাধারণ একটি সমস্যা। আলোচ্য রোগীর ইলেকট্রোফিজিওলজি স্টাডি পরীক্ষা করে তাঁর সমস্যাটির মূল চিহ্নিত করা হয় এবং একই সময়ে তাঁর রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনও করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে এ সমস্যাটি আর না হয়।
কেস স্টাডি-২
৫২ বছরের আফসার আহমেদ সরকারি কর্মকর্তা। তিনি আসেন হঠাৎ জ্ঞান হারানোর সমস্যা নিয়ে। এক মাসে তিনি তিনবার পুরোপুরি সংজ্ঞাহীন হয়ে গিয়েছিলেন অল্প সময়ের জন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা তাঁর সমস্যাটি ঠিক ধরতে পারছিলেন না। কারণ তাঁর যাবতীয় পরীক্ষার রিপোর্ট ছিল স্বাভাবিক। তিনি ইতিমধ্যে ইসিজি, ইটিটি, ইইজি, সিটি ব্রেইন, হলটার মনিটরিং, এনজিওগ্রাম, টেবিল টিল্ট টেস্ট ইত্যাদি পরীক্ষা করিয়েছিলেন।
তাঁর রোগের বিস্তারিত ইতিহাস নিয়ে এবং একটি ইলেকট্রোফিজিওলজি স্টাডি করে দেখা গেল, তাঁর সাইনোএট্রিয়াল কনডাকশন টাইম (এসএসিটি) এবং কারেকটেড সাইনাস নোড রিকভারি টাইম (সিএসএনআরটি) স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। অতএব তাঁর রোগের ডায়াগনোসিস দাঁড়াল সাইনাস নোড ডিজিজ বা সিক সাইনাস সিনড্রম (এসএসএস)। এট্রিওভেনট্রিকুলার (এভি) কনডাকশান স্বাভাবিক ছিল। পরদিন তাঁর শরীরে একটি পেসমেকার প্রতিস্থাপন করা হয়। চার মাস হতে চলল, আফসার সাহেব নিয়মিত ফলোআপে আসেন। বিভীষিকাময় সেই সংজ্ঞাহীনতা আর হয়নি তাঁর।
কেস স্টাডি-৩
১৮ বছর বয়সের আলী ইমরান এসেছিল ফেনী থেকে। মধ্যপ্রাচ্য-প্রবাসী বাবার একমাত্র সন্তানটি পড়ত মাদ্রাসায়। তার পড়াশোনা বন্ধের তো উপক্রম হয়েছেই, উপরন্তু দেখা দিয়েছে জীবননাশের আশঙ্কা। গত কয়েক বছরে সে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ভেনট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া নিয়ে। এর জন্য প্রতিবারই তাকে ইলেকট্রিক শক নিতে হয়েছে। কারণ লিগনোকেইন বা অ্যামিওডারোন ইনজেকশনে তার ভেনট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া ভালো হচ্ছিল না। যা হোক, আলী ইমরানের ইলেকট্রোফিজিওলজি স্টাডি করে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন করার পর সে এখন সুস্থ। তিনটি কেস স্টাডিতে দেখা গেল, রোগীদের ইলেকট্রোফিজিওলজি (ইপি) স্টাডির মাধ্যমে রোগ শনাক্ত করা হয়েছে এবং রেডিওফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা হয়েছে।
ইপি স্টাডির শুরু যেখানে
গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি হল্যান্ডের মাসট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় একই সময়ে অ্যান্টি-অ্যারিদমিক ওষুধ (হৃৎপিণ্ডের ছন্দনিয়ন্ত্রণের ওষুধ) ও অ্যান্টি-ট্যাকিকার্ডিয়া পেসমেকার যন্ত্রের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য প্রথম ইপি স্টাডি করা হয়। গত এক দশকে এর ব্যাপক ব্যবহার হয়েছে হৃৎপিণ্ডের সব ধরনের ছন্দহীন বা অনিয়ন্ত্রিত হৃৎস্পন্দনের চিকিৎসায় অ্যাবলেশনের প্রয়োগের মাধ্যমে। ১৯৭৭ সালে যখন প্রথম অ্যাবলেশনটি করা হয়, তখনো বেলুন এনজিওপ্লাস্টি ঠিকমতো শুরুই হয়নি।
কাদের ইপি স্টাডি করতে হয়
— অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন, অতি দ্রুত নাড়ির গতি বা প্যালপিটিশনের রোগীদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো হয় পরাভেনট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া বা এসভিটি। তবে কখনো কখনো ভেনট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া বা ভিটি থেকেও প্যালপিটিশন হতে পারে। ভিটি সর্বদাই এসভিটির চেয়ে বেশি বিপজ্জনক।
— যেসব রোগী সংজ্ঞাহীন বা অজ্ঞান হয়ে যায় (অথবা মাথা ঝিমঝিম করে, চোখে আঁধার দেখে এবং মাথায় হঠাৎ হালকা বোধ করে, যাকে প্রি-সিনকোপি বলে)।
— সিক সাইনাস সিনড্রম রোগীদের জন্য, বিশেষ করে যাদের ২৪ ঘণ্টার হল্টার টেস্ট, ও টেবিল টিল্ট টেস্ট নরমাল থাকে।
— একইভাবে এভি নোড ডিজিজেস রোগীদেরও ইপি স্টাডি করা যায়।
— বিভিন্ন ধরনের ভেনট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়ার রোগীদের যেমন হার্ট অ্যাটাকের পরের ‘স্কার ভিটি’, জ্নগত ফ্যাসিকুলার ভিটি ইত্যাদিতে।
— কোনো কোনো জ্নগত হৃদ্যন্ত্রের ত্রুটিতে, যেমন এআরভিডি, এবস্টেইন এনোমেলি ইত্যাদি।
— কখনো কখনো ইমপ্লেনটেবল কার্ডিওভার্টার ডিফিব্রিলেটর (আইসিডি) লাগানোর আগেও ইপি স্টাডি করা হয়।
কীভাবে করা হয়
এ পদ্ধতিটা কিছুটা এনজিওগ্রামের মতোই। রোগীর কুঁচকির গোড়ায় লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে কতগুলো বিশেষায়িত ক্যাথেটার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন চেম্বারে, বিশেষ করে ডান অলিন্দ, ডান নিলয়, বান্ডেল অব হিজ আর করোনারি সাইনাসে। কখনো কখনো বিশেষ করে বাঁ দিকের একসেসরি পাথওয়ে অ্যাবলেশনের জন্য বাঁ অলিন্দ এবং ভিটি অ্যাবলেশনের জন্য বাঁ নিলয়েও ক্যাথেটার দিতে হয়।
কতগুলো কানেকশন কেবলের মাধ্যমে ক্যাথেটারগুলো সংযুক্ত করা হয় দুটি জাংশন বক্স, একটি স্টিমুলেটর ও দুটি মনিটরের সঙ্গে। স্টিমুলেটরের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন চেম্বারকে পর্যায়ক্রমে উত্তেজিত করা হয় (পেসিং) এবং এরপর যে যে পথে হৃৎস্পন্দন অতিক্রম করে তা শনাক্ত করা হয়। একে বলা হয় ম্যাপিং।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দনের গতিবেগ, ইফেকটিভ রিফ্রেকটরি, পিরিয়ড, ভি-টু এ এবং এ-টু ভি কনডাকশন, এভি ওয়েনকেব্যাক পয়েন্ট প্রভৃতিসহ বহু উপাত্ত খুব অল্প সময়ে কেন্দ্রীয় মনিটরে সংরক্ষণ করে ইলেকট্রোফিজিওলজিস্ট রোগটি সঠিকভাবে নির্ণয় করে থাকেন।
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন কী
অ্যাবলেশনের অর্থ পুড়িয়ে দেওয়া। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন হচ্ছে সেই পদ্ধতি, যাতে অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দনের গতিপথকে স্থায়ীভাবে অকার্যকর বা নষ্ট করে দেওয়া হয়। এতে ৫০-৬০ ডিগ্রি সে· তাপমাত্রাকে ৪০-৭০ ওয়াট শক্তিতে নির্দিষ্ট ক্যাথেটারের মাধ্যমে অস্বাভাবিক স্পন্দনের নির্দিষ্ট পয়েন্ট বা ফোকাসে এক থেকে তিন মিনিট পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়।
এতে ওই পয়েন্টটি পুড়ে যায় (আক্ষরিক অর্থে নয়, কিন্তু যেহেতু তাপমাত্রা প্রয়োগের মাধ্যমে কাজটি করতে হয়, তাই পুড়িয়ে দেওয়া ও অ্যাবলেশন প্রায় সমার্থক)। পদ্ধতিটি অত্যন্ত নিরাপদ, দ্রুত ও ব্যথাহীন। অ্যাবলেশন ক্যাথেটারটির মাথা চ্যাপটা হওয়ায় হৃৎপিণ্ডের সবচেয়ে ভেতরের স্তরের সঙ্গে সংযোগ ভালো হয় এবং পদ্ধতিটি অপেক্ষাকৃত বড় স্থানে কাজ করে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের প্রায় সব অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দনের স্থায়ী চিকিৎসা দেওয়া যায়।
বাংলাদেশে ইপি স্টাডি
যুক্তরাষ্ট্র-প্রবাসী ডা· রফিক আহমেদের তত্ত্বাবধানে ২০০৪ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ইপি স্টাডি শুরু হয়। বর্তমানে এ হাসপাতালের পাশাপাশি ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন, ল্যাবএইড ও বারডেমের ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালে এ চিকিৎসা রয়েছে। এ চিকিৎসায় রোগীকে মাত্র এক রাত হাসপাতালে থাকতে হয়। চিকিৎসার ব্যয়ও অধিকাংশ রোগীর সাধ্যের মধ্যেই। আগে এ চিকিৎসা করাতে বিদেশে দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হতো। এখন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যেই তা করা সম্ভব হচ্ছে। রোগীদের সচেতনতা এবং সাধারণ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সময়োপযোগী সঠিক রেফারেন্স বাংলাদেশে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন চিকিৎসাকে অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারে।
হার্টের ইলেকট্রিক্যাল লাইনে ঝুটঝামেলা
ডা· মাহবুব মনসুর
জুনিয়র কনসালট্যান্ট
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ঢাকা
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০০৮
Md.Moniruzzaman
“এখন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যেই তা করা সম্ভব হচ্ছে। ” কিন্তু ইব্রাহিম কারডিয়াক এ শুধু এই ইপি স্টাডি করতে ২৮ হাজার & রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশনের জন্য মোট ৭৮ হাজার টাকা লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন। বিষয়টা কি দয়া করে clear করবেন।