সমস্যা: আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসি। মেয়েটিও আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু সমস্যা হলো, আমি মেয়েটির কাছে যেতেই ‘নারভাস’ হয়ে পড়ি। এমনকি কথা বলার সময় হাত-পাসহ সারা শরীরে কম্পনের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি।
শিবলু
পাবনা।
পরামর্শ: তোমার চিঠিটা খুব ছোট বলে অনেক তথ্য এখানে নেই। তাই বুঝতে পারছি না তোমার বয়স কত, ছেলেবেলা থেকে এই পর্যন্ত মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশার সুযোগ হয়েছে কি না, তোমার বয়সের কাছাকাছি কোনো আপন বোন বা খালাতো-মামাতো বোন আছে কি না, মেয়েদের প্রতি তোমার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুযোগ হয়নি বলে তুমি তাদের নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কল্পনার জগতে বিচরণ কর কি না—এই বিষয়গুলো জানা খুব জরুরি ছিল। কারণ ছেলেরা সাধারণভাবে মেয়েদের প্রতি বন্ধুসুলভ, শ্রদ্ধাশীল মনোভাব নিয়ে চললে যে মেয়েটির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাকে শুধু প্রেমিকা নয়, একজন ভালো বন্ধু হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নিতে পারে। আমাদের সমাজে বয়ঃসন্ধিকাল থেকে ছেলে ও মেয়েদের আলাদা করে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। তাই পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে খুব একটা সুস্থ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। এতে করে মেয়েদের প্রতি ভিন্ন ধরনের আকর্ষণ, ঔত্সুক্য ও সংকোচের জায়গাটি তৈরি হয়, যেগুলো পরবর্তী সময়ে ছেলেদের মধ্যে অপরাধবোধের সৃষ্টি করে। তাই আমার অনুরোধ, যে মেয়েটিকে তুমি ভালোবাসো, তাকে তোমার মতোই একজন মানুষ হিসেবে দেখতে চেষ্টা করো। সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে তুমি তোমার ছেলেবন্ধুদের যেমন একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে মনে স্থান দাও, ঠিক তেমনভাবে আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে তার একজন প্রকৃত বন্ধু হও। বিপরীত লিঙ্গের কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরির সময় কিছু শারীরিক চাহিদা মনকে বিপর্যস্ত করে ঠিকই, তবে সেটিকে জয় করতে পারলে অন্যজনের কাছ থেকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা আর গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সম্ভব।
সমস্যা: আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমার সমস্যা হচ্ছে, আমি একটা কাজ করে আসার পর ওটা নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করি, যে কারণে আমার মন খুব খারাপ থাকে। আমি মনোযোগ দিয়ে আর কোনো কাজ করতে পারি না। কিছুদিন আগে আমি একটা পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা দিয়ে আসার পর মনে হচ্ছে, আমি আরও অনেক কিছু লিখতে পারতাম। কেন লিখলাম না? এসব নিয়ে খুব মানসিক কষ্টে আছি। আর আমার স্মরণশক্তিও খুব দুর্বল।
জয়া।
পরামর্শ: মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে অনেক বেশি অপরাধবোধ কাজ করে বলে তুমি অবসেশনে ঢুকে যাচ্ছ। এতে করে অনেক বেশি পরিমাণে মানসিক শক্তি ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বলে অন্য কাজগুলোও ব্যহত হচ্ছে। এটা যা ইঙ্গিত করে তা হচ্ছে, তোমার ভেতর একটি অত্যন্ত সমালোচনামুখর সত্তা বাস করছে। যে সত্তাটি তোমার কোনো ভুলকেই মেনে নিতে পারছে না। এই সত্তাটিকে বেশি জোরালো হতে বাধা দিতে হলে তোমার অন্য একটি সত্তাকে কাজে লাগাতে হবে। সমালোচনার জায়গাটিতে না গিয়ে তোমার নিজেকে প্রথমে ভুল করার সম্পূর্ণ অধিকার দিতে হবে, তারপর ভবিষ্যতে নিজেকে শুধরে নেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। কোনো পরীক্ষায় লিখতে না পারলে যদি অপরাধবোধ এবং নিজেকে দোষারোপ করার ভেতর আটকে থাক, তাহলে পরবর্তী পরীক্ষায় ভালো করার সম্ভাবনা কমে যাবে। তবে একই চিন্তার জালে আবদ্ধ থাকার বিষয়টি যদি ক্রমাগত ঘটতেই থাকে, তাহলে তোমাকে কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলরের কাছে গিয়ে সাহায্য নিতে হবে। কারণ অত্যন্ত বিরক্তিকর ও পীড়াদায়ক অবসেশন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা যখন আবার কোনো কাজ বারবার করার প্রবণতায় চলে যাই, তখন এটি আরও জটিল আকার ধারণ করে। কাজেই বেশি সিরিয়াস হয়ে যাওয়ার আগেই সাহায্য নিলে মানসিক রোগ প্রতিরোধে একটি ভালো পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিগত সংখ্যাগুলোয় আমার আগের দেওয়া উত্তরগুলো থেকে কষ্ট করে টেলিফোন নম্বর খুঁজে বের করে নিয়ো, কেমন?
সমস্যা: বাবা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও সেই ছোটবেলা থেকে আমরা তাঁর আদর থেকে বঞ্চিত। কারণ তাঁর কাছে তাঁর বোন এবং তাঁদের সন্তানেরাই প্রিয় ছিল, এখনো আছে। ছোটবেলা দেখতাম, বাবা তাঁর ভাগ্নেদের কোলে করে বাজারে নিতেন আর আমরা তাঁর পিছু পিছু হেঁটে যেতাম। তখন এই তফাতটা বুঝতাম না। কিন্তু এখনো তাঁর নিরন্তর অবহেলা আমাকে দারুণ কষ্ট দেয়। জীবনের ২০টি বছর পার করলেও আজও সেই ক্ষতটা রয়েই গেছে। মাঝেমধ্যে বাবাকে দেখলে সেই পুরোনো ব্যথাটা মোচড় দিয়ে উঠে দুই চোখ অশ্রুতে ভরিয়ে দেয়।
রশীদ হাসান
সাভার, ঢাকা।
পরামর্শ: বুঝতে পারছি, অত্যন্ত প্রিয় মানুষটির অবহেলা তোমাকে মানসিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত করেছে। বাবা যদি নিতান্তই একটি উদাসীন মানুষ হতেন, অর্থাত্ কারও প্রতি স্নেহপ্রবণ না হতেন, তাহলে তোমার এতটা কষ্ট হতো না। চোখের সামনে শুধু বোনের সন্তানদের আদর করতে দেখা এবং তোমার প্রতি অবহেলার মনোভাব সত্যি খুব পীড়াদায়ক। তোমার এবং অন্য ভাইবোনের অবশ্যই অধিকার রয়েছে বাবার আদর আর মনোযোগ পাওয়ার। তোমার মায়ের কথা কিছু লেখনি। তিনি কি কখনো প্রতিবাদ করেছেন বাবার এই আচরণের? তাঁর সঙ্গে তোমার বাবার সম্পর্কটি কেমন, সে বিষয়গুলো জানতে পারলে ভালো হতো। তুমি তো এখন বড় হয়েছ। বাবাকে কি সরাসরি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে পারবে, তাঁর এই আচরণ তোমার জন্য কতটা কষ্টের কারণ হয়েছে? কথা বলার সময় তাঁকে দোষারোপ না করে তোমার আবেগের জায়গাটি তুলে ধরে এবং তাঁর আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তুমি চেষ্টা করে দেখতে পার, তিনি তাঁর ভাবনা আর অনুভূতিগুলো তোমার কাছে প্রকাশ করেন কি না। আর এই প্রতিজ্ঞাটি মাথায় রাখো যে তুমি নিজে যখন বাবা হবে, তোমার সন্তানদের প্রতি কখনো অবিচার করবে না।
পরামর্শ দিয়েছেন-
অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম
কাউন্সেলিং সাইকোলজি
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০০৯
Leave a Reply