* ১০৪ জন চিকিৎসক-নার্স-কর্মচারীর বদলি ও শাস্তির সুপারিশ
* কোনো দেনদরবারে শাস্তি রদ হবে নাঃ যুগ্ম সচিব
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে খোদ সরকারই উদ্বিগ্ন। হাসপাতালে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা সেবা গ্রহণ-কারীদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের একশ্রেণীর চিকিৎসক ও কর্মচারী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন, সেবার মানোন্নয়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদনে এ উদ্বেগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটি অন্তত ১০৪ জন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে বদলি ও বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সুপারিশ করেছে।
জানা যায়, জনসাধারণের অভিযোগ ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ আগস্ট স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ড· এ এম এম শওকত আলী মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব গোলাম কুদ্দুসের নেতৃত্বে পর্যবেক্ষণ ও পরিদর্শন কমিটি গঠন করেন। এ কমিটিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি হাসপাতালের পরিচালককে সদস্যসচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালককে (হাসপাতাল) সদস্য রাখা হয়।
এ কমিটি সম্প্রতি রাজধানীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল), জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি রোগ ইনস্টিটিউট এবং ইউরোলজি ও নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যার হাসপাতাল ঘুরে দেখে।
পরিদর্শনকালে কমিটি একশ্রেণীর চিকিৎসক ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও কর্মস্থলে অনুপস্থিতির অভিযোগ পায়। এর মধ্যে বেআইনিভাবে বাসা দখলে রাখা, বহিরাগতদের সরকারি বাসা ভাড়া দেওয়া, হাসপাতালের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে তা ভাড়া দিয়ে অর্থ আদায়, দালাল পোষা, হাসপাতালের আশপাশে নামে-বেনামে ক্লিনিক করে সেখানে সময় দেওয়া, রোগী পাঠানো ইত্যাদি অন্যতম। এ ছাড়া প্রতিটি হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতার অভাবও রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে শয্যা ও চিকিৎসকস্বল্পতা, প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবেও চিকিৎসাসেবার মান ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে। বিদ্যুৎ নিত্যদিনের সমস্যা। কিন্তু জেনারেটর থাকলেও মাঝেমধ্যে জ্বালানি তেল কেনার টাকা থাকে না। তাই জরুরি অস্ত্রোপচারের সময়ও বিদ্যুৎ গেলে ঝুঁকির মধ্যে থাকে রোগীরা।
কমিটির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালের ফিজিওথেরাপিস্ট মো· মনিরুজ্জামান ১৯৯৯ সাল থেকে হাসপাতালের কাজে অনুপস্থিত থেকেও পূর্ণ বেতন-ভাতা গ্রহণ করে আসছেন। এই হাসপাতাল পুলের বিভিন্ন শ্রেণীর ২২টি বাসা বহিরাগত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর অবৈধ দখলে আছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের এইচ/ডি নম্বরের বাসাটি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন ডা· মোহা· রবিউল আযম পাপ্পু। ২২ জনের মধ্যে ১১ জন হাসপাতাল কর্মকর্তা
নিজেদের দখলে থাকা বাসা আবার অন্যদের ভাড়া (সাবলেট) দিয়েছেন। অনেকে গাড়ির গ্যারেজ বাসায় রূপান্তর করে তা বাসা হিসেবে বহিরাগতদের কাছে ভাড়া দিয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্ষেত্রেও অভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ছাড়াও শয্যাসংকটের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে পরিদর্শন কমিটির প্রতিবেদনে। এক হাজার ৭০০ শয্যার এ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে আড়াই হাজার রোগী ভর্তি থাকে। শয্যার অতিরিক্তসংখ্যক রোগীকে দিনের পর দিন শয্যা ছাড়াই কাটাতে হয়। এ হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে চার হাজার রোগী চিকিৎসার জন্য এলেও সবার ভাগ্যে চিকিৎসা-পরামর্শও জোটে না। কারণ বহির্বিভাগে প্রয়োজনীয়সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স বা কর্মচারী নেই। হাসপাতালটি ৬০০ শয্যায় উন্নীত করার কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, সম্ভাব্য বদলির তালিকায় থাকা চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিচ্ছেন। নানাভাবে দেনদরবার বা পরিস্থিতি তৈরি করে বদলি বা শাস্তি ঠেকাতে তৎপর রয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ গোলাম কুদ্দুস বলেন, যাঁদের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ অনিয়ম করার অভিযোগ রয়েছে, কোনো দেনদরবারে তাঁদের শাস্তি রদ হবে না। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব খুবই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালঃ কমিটির প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা· হুসনে আরা বেগম; ডা· ফাহ্মিদা হাফিজ, সহকারী অধ্যাপক (ফিজিক্যাল মেডিসিন); ডা· মো· নোমান চৌধুরী, সহকারী অধ্যাপক (রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ); ডা· মো· সজিবুর রহমান, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন); ডা· মোজাম্মেল হক, ইএমও; ডা· মো· মাহাবুব আলম, ইএমও; ডা· মো· সাইফুল কবির খান, ইএমও; ডা· আলমগীর হোসেন, ওএসডি, নিউরোসার্জারি বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী, ঢাকা; ডা· তোফায়েল আহম্মদ, ওএসডি, নিউরোসার্জারি বিভাগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মহাখালী।
এ ছাড়া আছেন সোহরাব উদ্দিন খান (প্রশাসনিক কর্মকর্তা), খাদিজা বেগম (নার্সিং সুপারভাইজার), যমুনা রানী দাস (নার্সিং সুপারভাইজার), মর্জিনা খাতুন (সিনিয়র স্টাফ নার্স), মমতাজ বেগম (সিনিয়র স্টাফ নার্স), সাদিয়া আফরিন পুষ্প (সিনিয়র স্টাফ নার্স), জাহেদা খাতুন (সিনিয়র স্টাফ নার্স), রহিমা খাতুন (সিনিয়র স্টাফ নার্স), আনিছুর রহমান (সহকারী নার্স), শেখ আব্দুল হান্নান (রেকর্ডকিপার, রেকর্ড সেন্টার); আকবর হোসেন খোকা (ড্রাইভার, যানবাহন শাখা) ও আব্দুল্লাহ আল মামুন (ফার্মাসিস্ট, মেডিসিন স্টোর)। আরও আছেন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ১৪ জন কর্মচারী।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা· সজীবুর রহমান জানান, কিছুদিন আগে তিনি সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু সেখানে বদলি না করে উল্টো তাঁর বিরুদ্ধে হাসপাতালের পরিচালক মনগড়া অভিযোগ এনে তাঁকে বদলি করিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি স্বাস্থ্যসচিবের কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছেন। হাসপাতালের আরেক নার্স নেতা মো· আনিসুর রহমান বদলির জন্য হাসপাতালের পরিচালককে দায়ী করে বলেন, প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তিনি অধিকাংশ নিরীহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিচালক বদলির সুপারিশ করেছেন। তাঁর মতো অধিকাংশ কর্মচারী হাসপাতালের অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। তা ছাড়া দোষীদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন না হয়ে তাদের সংশোধনের সুযোগ কিংবা বিভাগীয় পদক্ষেপ নিতে পারতেন।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালঃ কমিটির প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন ডা· মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন (সহকারী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি); ডা· নীনা ইসলাম (সহরকারী রেজিস্ট্রার, কার্ডিওলজি); সুমনা নাহার (সুপারভাইজার সিস্টার)। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আছেন ছয়জন।
সহকারী অধ্যাপক ডা· মো· শাহাবুদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, পরিচালকের ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়ে তাঁকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদিল করা হয়েছে। তিনি ওই হাসপাতালে যোগও দিয়েছেন। তবে তিনি দাবি করেন, তিনি রোগী বাইরের হাসপাতালে বা ক্লিনিকে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত নন। তাঁর চাকরির নথিতেও এ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
পঙ্গু হাসপাতালঃ অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন অফিস সহকারী সুশীল চন্দ্র ও স্যানিটারি পরিদর্শক শহীদ উদ্দীন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আছেন ছয়জন। শহীদউদ্দিন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, হাসপাতালের পরিচালক ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে তাঁকে ঢাকার বাইরে বদলি করেছেন বলে তিনি শুনেছেন। তবে এখনো বদলির আদেশ পাননি। পরিচালক ইসহাক এই হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর তাঁকে কোনো কাজের দায়িত্ব পালন করতে দেননি। তাঁর দাবি, তিনি রোগীকে বাইরের হাসপাতালে পাঠানো তো দূরের কথা, ক্লিনিকের সামনেও কোনো দিন যাননি।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালঃ অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন ডা· রফিউদ্দিন আহমেদ, (এমও, ওপিডি); ডা· আবদুল লতিফ (এমও, ওপিডি); ডা· আরিফুল হক, (আর/পি, শিশু বিভাগ); ডা· সাইফুল করিম (ইএমও, জরুরি বিভাগ); ডা· মশিউর রহমান মল্লিক (ইএমও, জরুরি বিভাগ); ডা· সায়েমা আহমেদ, (আর/এস, গাইনি বিভাগ); দৌলতন নেছা, (উপ-সেবা তত্ত্বাবধায়ক); মো· তৌহিদুল জামান, (উপসহকারী প্রকৌশলী); মো· সাইফুল ইসলাম, (ফার্মাসিস্ট, ওপিডি); মো· মোবারক আলী দেওয়ান (প্রধান সহকারী); ডা· মোহিতুর রহমান (অনির্দিষ্ট সময় থেকে অনুপস্থিত এবং হাসপাতালে তাঁর কোনো নিয়োগপত্র কিংবা রিলিজ অর্ডার নথিভুক্ত নেই) ও মো· মনিরুজ্জামান (ফিজিওথেরাপিস্ট, যিনি বিগত ১৯৯৯ সাল থেকে হাসপাতালে অনুপস্থিত এবং একই সঙ্গে সরকারি ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পূর্ণ বেতন ভাতা ভোগ করেন)।
অভিযোগ সম্পর্কে ডা· সাইফুল করিম বলেন, ‘হাসপাতালের পরিচালক বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ড্যাবের সমর্থক। আর আমি আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সমর্থক। এ কারণে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে পরিচালক আমাকেসহ আরও কয়েকজন চিকিৎসককে বদলির সুপারিশ করেছেন। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শক দল পরিচালকের কথামতো কাজ করেছে।’ তাঁর দাবি, তিনি রোগী ভাগানো কিংবা দালালির সঙ্গে জড়িত নন। তাঁর বিরুদ্ধে আগে কখনো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়নি।
নারায়ণগঞ্জ ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালঃ এই হাসপাতালে মোট ১২টি বিভাগ আছে এবং ৫০ জন ডাক্তার কর্মরত আছেন বলে জানা যায়। হাসপাতালটির চিত্র খুব নাজুক। কমিটির প্রতিবেদনে অভিযুক্তের তালিকায় আছেন ডা· মনজুর আহমেদ (আর এস), ডা· জাহাঙ্গীর আলম (সিনিয়র কনসালট্যান্ট, গাইনি), ডা· আমীনা খান (জুনিয়র কনসালট্যান্ট), ডা· মোশাররফ হোসেন (জুনিয়র কনসালট্যান্ট-সার্জারি) ও ডা· সাবরিনা বিনতে রহমান (ডেন্টাল সার্জন)। এ ছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আছেন ১৪ জন।
মিটফোর্ড হাসপাতালঃ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে মিটফোর্ড হাসপাতালের যাঁদেরকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে, তাঁরা হলেন হাসপাতালের পরিচালক ডা· সোহরাব হোসেন। এ ছাড়া আছেন আরও তিনজন কর্মচারী। এ প্রসঙ্গে উপপরিচালক ডা· সোহরাব হোসেন পাল্টা অভিযোগ করেন, তাঁর চাকরির মেয়াদ আছে আগামী বছরের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। অবসরকালীন ছুটিতে (এলপিআর) যাওয়ার ছয় মাস আগে কাউকে বদলি করার কোনো আইন নেই। বদলির পেছনে হাসপাতালের পরিচালকের হাত রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
সূত্রঃ প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২২, ২০০৮
Leave a Reply