আপনি হয়তো গৃহিণী। সাংসারিক কাজের ব্যস্ততায় নিজের শরীরের যত্ন নেওয়ার সময় পাচ্ছেন না। অথবা কর্মজীবী একজন নারী, যাঁকে অফিসের চেয়ারে বসে কাটাতে হয় দীর্ঘ সময়। ভারী ব্যায়াম করা বা নিয়মিত ব্যায়ামাগারে যাওয়া আপনার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। অথচ স্বাস্থ্যের যত্ন তো নিতেই হবে।
আমরা সবাই জানি, স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীনতা কত রকমের সমস্যা ডেকে আনতে পারে। নারী-পুরুষ সবার জন্যই শরীরচর্চা অপরিহার্য। বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ, মোটা হয়ে যাওয়া, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, এমন সব শারীরিক সমস্যা তো আছেই, সেই সঙ্গে ক্লান্তি, অবসাদ, দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতার মতো মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে স্বাস্থ্যের প্রতি অযত্নের ফলে। একটু সচেতনতা আর হালকা শরীরচর্চার মাধ্যমেই কিন্তু আপনি পারেন এসব সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পেতে।
শরীরচর্চা করতে হলেই যে কঠিন কোনো ব্যায়াম করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অনেকেই ব্যায়াম করতে অস্বস্তি বা অনাগ্রহ বোধ করেন এ ধরনের ভারী ব্যায়ামের ভয়ে। আবার ঘরোয়াভাবে শরীরচর্চার সঠিক নিয়মকানুন না জানার কারণেও অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কিছুই করেন না। কেউ কেউ আবার মনে করেন, সারা দিনের এত কাজের পর আবার ব্যায়ামের কষ্ট! অথচ সব শরীরচর্চাই কিন্তু কষ্টদায়ক নয়। শরীরের যত্ন নেওয়ার পদ্ধতিটাও হতে পারে আরামদায়ক। সবচেয়ে বড় কথা হলো মনের তৃপ্তি, যা আপনি পাবেন সামান্য বাড়তি সচেতনতার মাধ্যমেই।
এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ও মেডিসিনের অধ্যাপক এম এ আজহার। তিনি জানান, হাঁটা, সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা, মেডিটেশন, যোগব্যায়ামের মতো শরীরচর্চাগুলো কাজের ফাঁকে সামান্য সময় বের করেই করে ফেলা যায়।
অধ্যাপক আজহার বলেন, ‘হাঁটাকে বলা চলে শ্রেষ্ঠ ব্যায়াম।’ শরীর সুস্থ-সবল রাখা থেকে শুরু করে মানসিক অবসাদ দূর করতে হাঁটার জুড়ি নেই। প্রতিদিন আধঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা হাঁটার মাধ্যমে মুক্তি পেতে পারেন হার্টের সমস্যা, মোটা হয়ে যাওয়া, কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়াসহ অসংখ্য সমস্যা থেকে। কিন্তু এই সময়টা বের করবেন কীভাবে? সামান্য একটু বুদ্ধি খাটিয়ে দৈনন্দিন কাজের সময়সূচি করে বের করতে পারেন এই সমস্যার সমাধান। একনাগাড়ে এক ঘণ্টা না হেঁটে সময়টা এভাবে ভাগ করে নিতে পারেন—ভোরে ১৫ মিনিট, দুপুরে ১৫ মিনিট, বিকেলে আধঘণ্টা। টানা এতক্ষণ হাঁটার মতোই ফল পাবেন। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে করতেই ১৫ মিনিট দ্রুত পায়চারি করে নিতে পারেন। এতে আপনার মস্তিষ্কও ঘুম ঘুম ভাব কাটিয়ে উঠে দ্রুত সজাগ ও সজীব হয়ে উঠবে। অধ্যাপক আজহার জানান, যাঁদের একেবারেই সময় নেই, তাঁরাও কর্মক্ষেত্রেই ১০ মিনিটের বিরতি নিয়ে অফিসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত একটু হেঁটে নিতে পারেন। এ ছাড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতে বা বাজারে যেতে রিকশা না নিয়ে হেঁটে যান। রিমোট কন্ট্রোল ব্যবহার না করে বারবার উঠে গিয়ে টিভির চ্যানেল বদলান। অফিসেও একনাগাড়ে বসে না থেকে এক ঘণ্টা পরপর উঠে পাঁচ মিনিট হাঁটাহাঁটি করুন। ঘরের কাজ করার সময়, কেনাকাটা করতে গিয়ে এবং যখনই সম্ভব হাঁটাহাঁটি করুন।
আরেকটি উপকারী ব্যায়াম হলো সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করা। লিফট, চলন্ত সিঁড়ির এই যুগে সিঁড়ি দিয়ে কষ্ট করে ওঠানামা আমরা এখন করতেই চাই না। কিন্তু প্রতিদিন সিঁড়ি দিয়ে বাড়তি কয়েকবার ওঠানামা আপনার ভারী ব্যায়ামের অভাবটা পূর্ণ করতে পারে। চেষ্টা করুন লিফট বাদ দিয়ে যত বেশি সম্ভব সিঁড়ি ব্যবহার করতে। অনেকেরই অফিস বহুতল ভবনে অবস্থিত। এ ক্ষেত্রে কাজের বিরতির সময় ১০ মিনিট সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পারেন।
প্রতিদিন ভোরে অল্প কিছুক্ষণ যোগব্যায়াম আপনার মনকে যেমন প্রশান্তি দেবে, তেমনি বজায় রাখবে আপনার শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যও। যোগাসনের সঠিক নিয়মকানুন জানা না থাকায় অনেকে এটা করতে ভয় পান। আবার অনেকের কাছে একে বেশ কঠিন বলে মনে হয়। কিন্তু অনেক সহজ আসনও রয়েছে, যা দিয়ে প্রাথমিকভাবে যোগচর্চা শুরু করতে পারেন। বাজারে যোগব্যায়ামের ওপর লেখা বই, সিঁডি ইত্যাদি পাওয়া যায়। টিভিতেও যোগাসনবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখানো হয়। এগুলোর সাহায্য নিয়ে বাড়িতে বসেই খুব সহজে শুরু করে দিতে পারেন যোগব্যায়ামের চর্চা।
শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভের আরেকটি পদ্ধতি হলো মেডিটেশন। মেডিটেশন আর কিছুই নয়, শরীর শিথিল বা রিলাক্স করে নিজের বিক্ষিপ্ত চিন্তা-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করা। ঘরে বসে তো করতে পারেনই, চাইলে কর্মস্থলে বসে কাজের ফাঁকেই ১০ মিনিট সময় বের করে করতে পারেন ধ্যানচর্চার জন্য। আরামদায়ক অবস্থানে বসুন। চোখ বন্ধ করে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করুন কোনো আনন্দদায়ক চিন্তা বা ভালো স্মৃতির ওপর। এমন কোনো অনুভূতির ওপর, যা আপনার মনে উত্সাহ ও উদ্দীপনা জাগায়। তাত্ক্ষণিকভাবে ক্লান্তি কমিয়ে আনতে এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।
মেডিটেশনের ওপরও বিভিন্ন বইপত্র, সিডি বাজারে পাওয়া যায়, যা আপনাকে এ ব্যাপারে আরও জানতে সাহায্য করবে।
এ ছাড়া অধ্যাপক আজহার পরামর্শ দেন, যাঁরা অতিরিক্ত মেদবহুল, অথচ জিমনেশিয়ামে যেতে চান না, তাঁরা ব্যায়ামের কিছু সহজ যন্ত্রপাতি কিনে ঘরে বসেই শরীরচর্চা করতে পারেন।
সামান্য সময় নিয়ে নিয়মিত এই চর্চাগুলো ফিরিয়ে দিতে পারে আপনার কর্মোদ্যম, মনের প্রশান্তি। শরীরও হয়ে উঠবে অনেক ঝরঝরে, সুস্থ, সবল। তাই শরীরের যত্ন নিন। নিজের দিকে খেয়াল রাখুন।
সিফাত মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৯
Leave a Reply