কাশবনে হারিয়ে গেছে অপুর দিদি দুর্গা। অপু তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। শেষে কাশবনেই অপু পেয়ে যায় দিদির খোঁজ। এবার কাশবনের পথ ধরেই অপু-দুর্গার দ্রুতলয়ের দৌড়! সত্যজিত্ রায়ের পথের পাঁচালী যাঁরা দেখেছেন, এসব দৃশ্য তাঁদের কাছে ভোলার নয়। আর যাঁরা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী পড়েছেন, তাঁরাও নিশ্চয়ই নিজের মনে কাশবনের একটি চিত্রকল্প তৈরি করে নিয়েছেন। পথের পাঁচালীর মতো ছেলেবেলায় কাশবনের পথ ধরে রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার স্মৃতিও হয়তো অনেকের আছে। শরতের শুভ্র কাশবন দেখে সেই স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াতে পারে কারও কারও মন। সেই সময়টা যাচ্ছে এখন।
শরতের প্রথম মাসটি এরই মধ্যে শেষ। এখন আশ্বিনের মাঝামাঝি সময়। কাশবন ছেয়ে যাওয়ার কথা সাদা ফুলে। আকাশে ভাসবে শারদীয় মেঘ। চিরচেনা অনেক দৃশ্যের মতো এসব দৃশ্যপটও কি হারিয়ে গেছে? তাই এ শরতে অনুজ এক আলোকচিত্রী বন্ধুর মুঠোফোন বেজে ওঠে। তার জিজ্ঞাসা, ‘ভাই, কাশ ফুটেছে?’ বললাম, ‘ফুটলে জানাব।’ এদিকে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘের আনাগোনা আকাশজুড়ে। শরতের বৃষ্টি আমাদের কাশফুল দেখার আকাঙ্ক্ষা ভুলিয়ে দিতে পারেনি। একদিন মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গাবতলী, আমিনবাজার, শালিপুর, হেমায়েতপুর হয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। কাশবন তো দূরের কথা, একটা কাশফুলেরও দেখা মেলে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সঙ্গীতা আচার্যকে ফোন দিই। ও তখন ধামরাইয়ে। কিছুটা আফসোস করে বলে, ‘ভাইয়া, কাশ ফুটলে আমি খবর দেব।’ আমাদের দীর্ঘশ্বাসে প্রকৃতি বুঝি একটু সদয় হয়। একদিন কাশবনের খবর পাওয়া যায়। অনুজপ্রতিম ইমরান খবরটা নিয়ে আসে। কাশবন দেখার জন্য তৈরি হয়ে যাই আমরা ঢাকা হেরিটেজের বন্ধুরা।
তারপর দে ছুট কাশবনের দিকে। সেটা ঈদুল ফিতরের আগের দিন। জনা দশেকের দলটা চলে যাই বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পারে হাসনাবাদে। সেনাছাউনির পাশে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই কাশবন। যত দূর চোখ যায়, কেবল কাশ আর কাশ। দিনের দিগন্তজোড়া চনমনে রোদ, আকাশে ভাসছে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘ। সাদা কাশফুল খেলা করছে বাতাসের সঙ্গে। ভ্রমণসঙ্গীরা যেন ফিরে যায় শৈশবে। কাশবনে দৌড়ঝাঁপ করতে থাকে সবাই। সাইফুলের আঞ্চলিকতামাখা কণ্ঠে কবিতা আর বুলুনির হেঁড়ে গলায় গান। এতেই সবার কী আনন্দ! আমাদের যাদের ক্যামেরা আছে, সেগুলো তখন সচল। ক্যামেরা তখন ধরছে ছবি। শুধু কি ছবি, ক্যামেরায় তৈরি হচ্ছে একেকটি কবিতা, একেকটি গল্প। সেই কবিতা বা গল্প কাশফুলে হাত বুলিয়ে দেওয়ার, গাল ছুঁয়ে যাওয়ার। আমাদের কাশবন ভ্রমণে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তাঁর মধ্যেও দেখেছি কৈশোর-উচ্ছ্বাস।
আমাদের দল হাসনাবাদ পার হয়ে মাইল দুয়েক দূরে মোল্লারপুর চলে যায়। এটা কেরানীগঞ্জেরই একটা অংশ। এখানে বিশাল জায়গাজুড়ে কাশফুলের মেলা। সেখান থেকে কদমপুর। এখানে কদম আলী মস্তান (রহ.)-এর দরবার শরিফের পেছনের বেলাভূমিতে কাশফুলের সমারোহ। কাশফুলের শুভ্রতা নিয়ে আমাদের বাড়ি ফেরা। তারপর আমার একাকী ভ্রমণ ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়। সঙ্গী শুধু একখানা ক্যামেরা। কাশবনের ছবি তুলি গাবতলী থেকে সাভার। টঙ্গীর টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাঠজোড়া কাশফুলও ধরা দেয় আমার ক্যামেরায়। এসব ছবি ই-মেইল করি এক বন্ধুকে। তার পাল্টা ই-মেইল বার্তা, ‘চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এই নগরে এত কাশফুল, একসঙ্গে!’
কাশফুল দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সব জায়গাতেই দেখা যায়। নদীর ধারে এর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে বালুতে কাশ খুব ভালো হয়। এ ছাড়া চর এলাকায়, এমনকি শুষ্ক-রুক্ষ ও পাহাড়ি এলাকায়ও কাশ জন্মায়। লাল ও শক্ত মাটির কাশ আকারে ছোট হয়। সে তুলনায় পাহাড়ি কাশ বিশাল। কাশফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum Spontaneum. এটি Poaceae পরিবারের সদস্য। হিন্দি নাম কান্স বা কানিস। পাহাড়ের কাশকে বলা হয় পাহাড়ি কাশ ও তেজ। এরা একই গোত্রের বেশ ঘনিষ্ঠ দুই প্রজাতি। উদ্ভিদবিজ্ঞান বলে, কাশ ও আখ খুব ঘনিষ্ঠ দুই প্রজাতি। অন্যদিকে দুর্গাপূজার সঙ্গে কাশের রয়েছে আত্মীয়তা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, দুর্গাপূজা আসে কাশফুলকে সঙ্গী করে। পূজায় এর ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য এই দুর্গাপূজা ও কাশফুল।
কাশবনের ঠিকানা: ঢাকা নগরের কাছেই বুড়িগঙ্গার ওপারে হাসনাবাদে আছে কাশবন। গুলিস্তান থেকে বাসে পোস্তগোলা (বুড়িগঙ্গা) সেতু যেতে হবে। ভাড়া পাঁচ টাকা। সিএনজিচালিত অটোরিকশায়ও যাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে গুলিস্তান থেকে লাগতে পারে শখানেক টাকা। পোস্তগোলা সেতু থেকে হাসনাবাদে যাওয়া যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টেম্পো অথবা রিকশায়। হাসনাবাদ সেনাছাউনির পাশেই বিশাল কাশবনের দেখা মেলে। ঢাকার আরেক প্রান্ত গাবতলী থেকে আরিচা পর্যন্ত মহাসড়কের দুই পাশে চোখে পড়বে সারি সারি কাশবন। কাশবন রয়েছে টঙ্গীতে টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাঠজুড়ে।
ফারুখ আহমেদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৯
Leave a Reply