ডাঃ ফজলে রাব্বি খান
কথা হচ্ছিল মিসেস সেগুফতার সঙ্গে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কী ব্যাপার, জিজ্ঞেস করতেই−আরে ভাই বইলেন না, ভুলবশত একই সময়ের ইনসুলিন দুবার নিয়ে ফেলেছি। ব্যস, কী যে দুর্বলতা, মাথা পুরো হালকা, কোত্থেকে যেন রাজ্যের অবসাদ এসে ভর করল। বুঝতে পারলাম এটা ‘হাইপো’। রক্তের সুগার মেপে দেখলাম ২-এর একটু নিচে। তারপর একটু পর পর এটা খাচ্ছি ওটা খাচ্ছি এবং রক্তের সুগার মাপছি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। সুগার কোনোভাবেই বাড়ছে না, এভাবে সারা রাত কেটে গেল। ভয়ে সারা রাত ঘুমাইনি পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে।
শুধু সেগুফতা কেন, যেকোনো ডায়াবেটিস রোগীই যেকোনো সময় যেকোনো কারণে এ সমস্যায় পড়তে পারে। জানা থাকতে হবে, কীভাবে এ থেকে দ্রুত উত্তরণ ঘটানো যাবে।
চিকিৎসকেরা সাধারণত কারও রক্তের সুগার বা গ্লুকোজ একটা নির্দিষ্ট বা স্বাভাবিক মাত্রার ওপরে থাকলে তখন বলেন ডায়াবেটিস বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া; এবং এই ওপরে থাকা হাইপারগ্লাইসেমিয়া স্বাভাবিক মাত্রায় আনার জন্য নানা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যদি কখনো কোনো কারণে এই হাইপারগ্লাইসেমিয়া স্বাভাবিক মাত্রায় আসার পরিবর্তে বেশি কমে যায়, তবে তা হলো হাইপোগ্লাইসেমিয়া। সংক্ষেপে ‘হাইপো’।
হাইপো-ভীতি কেন
‘হাইপো’ মানে শরীরে রক্তের গ্লুকোজ কমে যাওয়া। আর আমাদের শরীরের প্রধান চালিকাশক্তি এই গ্লুকোজ বা সুগার বা শর্করা। মস্তিষ্ক ও স্নায়ু তো একদমই অচল এই গ্লুকোজ ছাড়া। সহজেই অনুমান করা যায়, শরীরে গ্লুকোজের ঘাটতি হলে কিংবা ঘাটতি হতে হতে একদম গ্লুকোজশূন্য হয়ে পড়লে কী ধরনের শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়। হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে শরীরের যেকোনো অঙ্গের ক্ষতি, অর্থাৎ অকার্যকারিতাসহ রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
হাইপো’র সতর্কসংকেত
বেশ কিছু সতর্কসংকেত থেকে সহজেই হাইপোগ্লাইসেমিয়া চিহ্নিত করা যায়। যেমন: হঠাৎ দুর্বলতা, মাথাব্যথা, অতিরিক্ত ঘাম, শরীর কাঁপা, অবসাদ, হার্টের গতি বেড়ে যাওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা কিংবা একটি বস্তুর দুটি প্রতিবিম্ব দেখা, হঠাৎ ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়া।
নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাঝে মাঝে রক্তের সুগার মেপে দেখতে হবে। রক্তের সুগার ২ দশমিক ৫ মিলি মোল/লিটারের নিচে নেমে গেলেই হাইপো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। কারণ, ঠিক হাইপো নয়, হাইপোর মতো বলে একটা বিষয় আছে। যেমন, অনেকেই দীর্ঘদিন রক্তের সুগার অনেক বেশি থাকায় অভ্যস্ত, তাদের যদি চিকিৎসা কিংবা অন্য কোনো কারণে রক্তের সুগার হঠাৎ কমে যেতে শুরু করলেও হাইপোর সতর্কসংকেতগুলো প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু রক্তের সুগার মেপে দেখলে দেখা যাবে কাঙ্খিত মাত্রা অর্থাৎ ছয় মিলি মোল/লিটারের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই সতর্কসংকেত দেখামাত্রই রক্তের সুগার মেপে দেখতে হবে।
এসবের সবই করবেন, যদি আপনি বুঝতে পারেন। অর্থাৎ দিনের বেলা এবং যে সময় আপনি জেগে থাকেন। কিন্তু যদি আপনি ঘুমিয়ে থাকেন, তাহলে? ঘুমের মধ্যেও হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। যদি প্রকোপ খুব বেশি না হয়, তবে দুঃস্বপ্ন বা অস্থির লেগে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। কিংবা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অসম্ভব দুর্বল, মাথাব্যথা, উত্তেজিত ভাব এবং কনফিউশনের মতো উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে। সাধারণত এ সময় রক্তে সুগারের মাত্রা বেশি পাওয়া যায়।
কেন এই হাইপো
একজন ডায়াবেটিস রোগী যে যে কারণে হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে, সেগুলো হলো−
* খাবার খেতে ভুলে যাওয়া, সময়মতো না খাওয়া, অর্থাৎ দেরি করা কিংবা প্রয়োজন অনুযায়ী না খাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ৮০ শতাংশ হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় এ কারণে।
* হাইপারগ্লাইসেমিয়ার জন্য যখন কেউ অতিরিক্ত ইনসুলিন নেয় বা খাবার ট্যাবলেট খায়। যেমনটি হয়েছে মিসেস সেগুফতার ক্ষেত্রে।
* যখন কেউ অতিরিক্ত ব্যায়াম করে বা ভারী কাজ করে।
* যখন কেউ অতিরিক্ত মদ্যপান করে।
* যখন বমি বা পাতলা-পায়খানা হয়ে শরীর থেকে খাবার বেরিয়ে যায়।
কী করবেন
যেহেতু হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় শর্করা বা গ্লুকোজ ঘাটতি বা কমে যাওয়ার জন্য, সেহেতু এ ক্ষেত্রে প্রধান ও একমাত্র করণীয় দ্রুত শর্করা বা গ্লুকোজের মাত্রাকে উচ্চ বা স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসা। এ ক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব ১০-১৫ গ্রাম সহজ শর্করা গ্রহণ করতে হবে, যা পাওয়া যাবে এক থেকে দুই চা-চামচ চিনি বা মধু বা গুড় থেকে; অথবা দুই থেকে চারটা গ্লুকোজ ট্যাবলেট থেকে; অথবা দুই থেকে চার পিস ক্যান্ডি থেকে; কিংবা গ্লাসের অর্ধেক বা চার ভাগের তিন ভাগ ফলের রস বা চিনির শরবত থেকে।
১৫ মিনিট পর আবারও রক্তের সুগার মাপতে হবে। যদি সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ে না আসে, তবে আবার একইভাবে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম শর্করা গ্রহণ করতে হবে এবং ১৫ মিনিট পর রক্তের সুগার মাপতে হবে। যদি এতেও স্বাভাবিক মাত্রায় না আসে, তবে হালকা স্ন্যাক্স খেতে হবে। যদি এত কিছুর পরও রক্তের সুগার স্বাভাবিক না হয়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
কোনো রোগী যদি অজ্ঞান হয়ে যায়, তবে জোর করে মুখে কিছু দেওয়া ঠিক হবে না। এ অবস্থায় দাঁত ও গালের মাঝখানে চিনিজাতীয় কিছু ঘষে দেওয়া যেতে পারে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে শিরাপথে গ্লুকোজ দেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা।
রোজার সময় করণীয়
রোজার সময় অনেকেই মনে করেন, ডায়াবেটিস রোগ থাকলে একদমই রোজা রাখা যাবে না। আবার কেউ কেউ এ ধরনের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও রোজা রেখে রোগকে আরও জটিল করে তোলে। দুটোর কোনোটাই ঠিক নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করে যে-কেউ রোজা রাখতে পারে। তবে যে বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে সেগুলো হলো:
একঃ মোট ক্যালরির মাত্রা: ডায়াবেটিস রোগীদের রোজা রেখেও সেহরি, ইফতার ও সন্ধ্যারাতের খাবারের মোট ক্যালরির মাত্রা যেন অন্যান্য সময়ের ক্যালরির মাত্রার সমান থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজন হলে একজন পুষ্টিবিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্যতালিকা মেনে চলতে হবে।
দুইঃ ইনসুলিন কিংবা মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট: অনেকেই রোজার সময় যেহেতু দিনের বেলা খায় না, তাই চিকিৎসাও নিতে চায় না। আবার অনেকে যেহেতু ইনসুলিন কিংবা ট্যাবলেট খায়, তাই রোজা রাখতে চায় না। এ দুটির কোনোটিই ঠিক নয়। এ বিষয়টি চিকিৎসকের ওপর ছেড়ে দিন। তিনিই ঠিক করবেন আপনার জন্য কোনটি প্রযোজ্য। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিনের মাত্রা এবং নেওয়ার সময়ের সুসমন্বয় করে সহজেই রোজা রাখা যায়। আর এ প্রয়াসকে আরও কার্যকর করেছে আধুনিক নতুন নতুন ইনসুলিন। অর্থাৎ অ্যানালগ ইনসুলিন। যেগুলোর কোনো কোনোটির খাবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, ২৪ ঘন্টায় একবার নিলে চলে। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা একদমই নেই। যেহেতু ‘হাইপো’ হওয়ার ভয় নেই এবং একবার নিলে চলে, তাই রোজার সময় এ ইনসুলিন সহজেই ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে।
আবার কোনো কোনো খাবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেগুলো অল্প সময়ের ব্যবধানে খাবারের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে নিলেই চলে। আর দিনে একবার মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট রাতের কোনো এক সময় খেয়ে নিয়ে সারা দিন রোজা রাখা যায়।
তিনঃ রক্তের সুগার মাপা: রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর প্রধান সমস্যা ‘হাইপোগ্লাইসেমিয়া’। কাজেই রোজা রেখেও নিয়মিত বিরতিতে রক্তের সুগার মাপতে হবে। সেহরি খাওয়ার ১০ থেকে ১২ ঘন্টা পর রক্তের সুগার মাপলে আপনি অভুক্ত অবস্থার বা ফাস্টিং ব্লাড সুগার পাবেন। যদি সারা দিন কোনো রকম অস্বাভাবিকতা বোধ না করেন, তবে এ পরীক্ষা ইফতারের আগেও করতে পারেন। যখনই করেন না কেন, স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে সুগার বেশি কমে গেলে অবশ্যই নিয়মিত বিরতিতে সুগার মাপবেন এবং ‘হাইপো’ সম্পর্কে নিশ্চিত হলে রোজা ভেঙে ফেলে রক্তের সুগার স্বাভাবিক হওয়ার ব্যবস্থা করবেন। মনে রাখবেন, রোজা রেখে নিয়মিত বিরতিতে রক্তের সুগার মাপা যায়, এতে রোজা নষ্ট হয় না।
চারঃ কায়িক পরিশ্রম: অনেকেই রোজা রেখে পরিশ্রম কিংবা ব্যায়াম কমিয়ে দেয়। এটা উচিত নয়। কারণ, ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের সুগার ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
কাজেই হাইপোগ্লাইসেমিয়া যেমন আতঙ্কের, তেমনি একে প্রতিরোধ করাও সহজসাধ্য। প্রয়োজন আপনার সচেতনতা। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজা রাখুন। অযথা স্বাস্থ্যসমস্যা জটিল করবেন না। আমরা আশা করব আপনার ধর্ম ও বিশ্বাসের সঙ্গে শরীরও সুরক্ষিত থাকবে।
সূত্রঃ যায়যায়দিন, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০০৮
Leave a Reply