সমস্যা : আমি একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। আমাকে বাসায় এসে যিনি পড়ান তিনি একজন স্কুলশিক্ষক। এর আগে যিনি পড়াতেন তিনি একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী ছিলেন। শুধু সে কারণেই আমার আব্বু তাঁকে বাদ দিয়ে আব্বুর পরিচিত এক শিক্ষককে নিয়ে আসেন। আগের স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা খুব ভালো ছিল। বর্তমান স্যারের সঙ্গেও যে সম্পর্কটা খারাপ ছিল তা নয়। একদিন সন্ধ্যাবেলা আব্বু-আম্মুসহ সবাই চাচার বাসায় বেড়াতে গেলেন। টিচার আসবেন বলে আমিই কেবল গেলাম না। পড়ানোর একপর্যায়ে স্যার আমাকে বললেন, ‘আজ তোমার কাছে একটা জিনিস চাইব, তুমি কিন্তু না করতে পারবে না। আমি রাজি হওয়ার পর স্যার আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে বলেন। স্যারের কথামতো আমি প্রতিজ্ঞা করি। পরে তাঁর প্রস্তাব শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই। কিন্তু প্রতিজ্ঞার ভয় দেখিয়ে স্যার আমাকে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করেন। পরদিন থেকেই তিনি আবার এমন ব্যবহার করছেন যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু আমি এক মুহূর্তের জন্যও স্বাভাবিক হতে পারছি না। শত চেষ্টা করেও কাউকে বলতে পারছি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: একজন শিক্ষকের এমন আচরণ সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষকতার পেশায় যাঁরা নিয়োজিত তাঁরা অন্য দশজনের মতো মানুষ। কিন্তু সঙ্গে এটাও সত্যি, তাঁদের কাছ থেকে সমাজ অনেক বেশি প্রত্যাশা করে এবং তাঁদের নৈতিক অবক্ষয় সমাজে খুব ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। আমি কাউন্সেলিং সেশনে বসে অনেক মেয়ের কাছ থেকে শুনি তারা অনেক অল্প বয়সে গৃহশিক্ষকের এ ধরনের আচরণের শিকার হয়েছে। অনেক সময় তারা পরিবারের বড় কাউকে বা মাকে কোনোভাবে সেটি জানানোর চেষ্টা করেছে; কিন্তু বড়রা তা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে চাননি। আমি মনে করি, অভিভাবকদের এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। গৃহশিক্ষক আসবেন জেনেও তোমাকে বাড়িতে একা রেখে যাওয়াটা অভিভাবকদের একেবারেই ঠিক হয়নি।
মায়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কেমন, বড় কোনো বোন আছে কি না তা জানি না, তবে তোমার কিন্তু দায়িত্বশীল কাউকে এ কথাটি জানাতেই হবে। কারণ কাউকে না জানালে তোমাকে এই তিক্ত ও অপমানজনক অভিজ্ঞতার জের বইতে হতে পারে সারা জীবন। এতে করে অনেক বড় ধরনের মানসিক ক্ষতির সম্ভাবনাও থেকে যায়। তথাকথিত শিক্ষকটি যেহেতু সাহস করে একবার ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তুমি কাউকে না বললে সে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। তোমার সামনে একটি সুন্দর ভবিষ্যত্ রয়েছে। আমি আশা করব, দ্রুত তুমি বিষয়টি পরিবারের কাউকে জানিয়ে এই শিক্ষকের কাছে যাতে আর পড়তে না হয় সে ব্যবস্থা করবে। একজন শিক্ষক তো শুধু পড়ালেখা শেখানোর কাজ করেন না, তাঁকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের কাছে ‘আদর্শ’ হতে হয়। শিক্ষকের একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে নৈতিকতাবোধ, সুস্থ জীবনবোধ ও উন্নত মানসিকতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। তুমি তো এই শিক্ষকরূপী লোকটির কাছে এসব কিছুই শিখতে পারবে না, বরং একটি বিভ্রান্তির ভেতর পড়ে তুমিও কখনো বিপথে পা বাড়াতে পার। আমাকে বিষয়টি সম্পর্কে লিখে অনেক সাহসের পরিচয় দিয়েছ। এই সাহসটুকু ব্যবহার করে তুমি এমন শিক্ষকের মুখোশটি সবার কাছে উন্মোচন করে নিজেকে এবং অন্য মেয়েদের তার বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করবে বলে আমি আন্তরিকভাবে আশা করব। লজ্জা বা অপমানবোধ তাঁরই হওয়া উচিত, যে তোমার সরল বিশ্বাসের সুযোগ গ্রহণ করেছে। কাজেই নিজের এই ভুলের জন্য নিজেকে ছোট না করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল না করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হও।
সমস্যা: আমার বয়স ১৬। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সদস্য। আমার সমস্যাটি পারিবারিক। আমার মা প্রায় সর্বক্ষণ পরিবারের সবার সঙ্গেই অযাচিত আচরণ করেন। আব্বার কোনো দোষ না থাকলেও সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করেন। আমি ছাত্র হিসেবে ভালো এবং পড়ালেখার বাইরেও আমার অনেক প্রতিভা আছে; কিন্তু এমন একটা পরিবারে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ নেই বলে আমার মনে হয়। নিজেকে মাঝেমধ্যে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে বাধা-বিপত্তির মধ্যেই জীবনের মর্ম বোঝা যায়। কিন্তু ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। মার ব্যবহারে মাঝেমধ্যে চরম ধৈর্যচ্যুতিও ঘটে। তখন ইচ্ছা করে আত্মহত্যা করি কিংবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাই; জীবনটাকে অর্থহীন মনে হয়। জন্মের পর থেকে জেনে আসছি, সন্তানের প্রতি মায়ের অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকে। কিন্তু আমার মার মধ্যে এর প্রতিফলন খুব কমই দেখেছি। দিন দিন হতাশ হয়ে পড়ছি এবং পড়ালেখারও ক্ষতি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ: এত অল্প বয়সে তুমি অনেক বেশি হতাশার মধ্যে পড়ে গেছ। বাড়িতে শান্তি না থাকলে আমরা সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। বিশেষ করে মা-বাবার সুসম্পর্ক সন্তানদের জন্য যেমন আশীর্বাদ হয়, ঠিক তেমনি তাঁদের নেতিবাচক সম্পর্ক সন্তানদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। তোমার মা কি অযথাই ঝগড়া করেন? তাহলে সম্ভবত তিনি কোনো কারণে খুব অশান্তিতে রয়েছেন, আর না হয় তাঁর মধ্যে কোনো অসুস্থতা দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে মানসিক রোগ এবং সমস্যাগুলো নিয়ে সচেতনতা ও জ্ঞান খুব কম বলে এগুলোকে সময়মতো চিহ্নিত করা হয় না এবং ফলস্বরূপ পরিবারের সব মানুষ কষ্ট পেতে থাকে। তুমি কি বাবার সঙ্গে বা বড় কারও সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকায় এসে কোনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে একটি ‘ফ্যামিলি থেরাপি’ সেশন নিয়ে নিতে পার? ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট পরিবারের সবার সঙ্গে কাঠামোবদ্ধ আলোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারবেন সমস্যাটি কীভাবে তৈরি হচ্ছে। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তোমাকে আরও ধৈর্যধারণ করতে হবে।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তুমি নিজের ভবিষ্যত্ গড়ে নেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেবে। তোমার প্রতিভাগুলোর কীভাবে বিকাশ ঘটানো যায় সে ব্যাপারে অন্তত কিছু পরিকল্পনা এখন থেকেই করা সম্ভব কি না সে ব্যাপারেও ভাবতে শুরু করো, কেমন? তোমার মা নিজেকে যথেষ্ট ভালোবাসতে বা শ্রদ্ধা করতে পারছেন না বলে তোমার প্রতি স্নেহপ্রবণ হতে পারছেন না। এটিকে তাঁর একটি বড় ধরনের অক্ষমতা হিসেবে দেখে, চেষ্টা করে দেখ নিজের কাজগুলো কিছুটা হলেও ঠিকমতো করতে পার কি না।
অধ্যাপক ড· মেহতাব খানম
মনোবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: প্রথম আলো, অক্টোবর ০৩, ২০০৯
Leave a Reply