ওষুধ নিয়ে কথা
ডাঃ এম শহীদুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
এসপিআরসি অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা
পাশ্চাত্যে এই বিষয়টি বেশি পরিচিত। এর মানে একাধিক ওষুধ সেবন এবং তার সংযোজিত বা পরিবর্ধিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ব্যবস্থাপত্রে একাধিক ওষুধ থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে চিকিৎসককেই এসবের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলে দিতে হবে, বুঝিয়ে দিতে হবে। যেসব ওষুধে ঘুমের প্রভাব আছে, যেমন−অ্যান্টিহিস্টামিন, অ্যান্টিডিপ্রেসন্টি সেবনের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিতে গেলে সতর্ক থাকতে হবে।
বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া বা অন্যান্য স্নায়ুরোগে বৃদ্ধরাই বেশি ভোগেন। একই রোগীর একাধিক রোগ থাকলে একাধিক ওষুধ দিতে হবে।
তবে ওষুধের মাত্রা ও সংখ্যা সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে হবে। একই ধরনের ওষুধের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একাধিক রোগে ভোগা জটিল রোগীদের ক্ষেত্রেই এটা বেশি হয়। এসব রোগীর জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম ব্যবস্থাপনা জরুরি।
একাধিক বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত দলের সদস্যরা একসঙ্গে বসে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রকে রেশনালাইজ করে দেবেন। উন্নত দেশে জটিল রোগীদের এভাবেই চিকিৎসা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন।
এখানে রেফারেল সিস্টেম না থাকায় যেকোনো রোগী যেকোনো সময় যেকোনো চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন। কারও হয়তো ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবেটিসের চিকিৎসক তাঁকে কিছু ওষুধ দিলেন। বুকে ব্যথা নিয়ে তিনি হয়তো কোনো হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলেন। তিনিও তাঁকে কিছু ওষুধ দিলেন। আগের চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের পুনরাবৃত্তি হলো কি না, তা দেখার সময় ও সুযোগ কোনোটাই হয়তো তাঁর নেই। এরপর তিনি হয়তো কোমরব্যথা নিয়ে ফিজিক্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে, তিনি হয়তো তাঁকে একটি ব্যথার ওষুধ, গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধের জন্য একটি অমিপ্রাজল ধরনের ওষুধ, ঘুমের ওষুধ ও একটি ভিটামিন দিলেন।
তিনি যদি আগের চিকিৎসকের ওষুধ না দেখে থাকেন, তাহলে দেখা যাবে, আগের দুজন চিকিৎসক হয়তো একই ধরনের বা একই গ্রুপের ওষুধ দিয়েছেন। রোগীরও এই রিপিটেশন না বোঝার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা ওষুধ তো জেনেরিক নামে বিক্রি হয় না, হয় ট্রেড নামে।
একই ওষুধের একেক কোম্পানির ট্রেড-নাম একেক রকম। কাজেই সর্বশেষ চিকিৎসককে রোগীর চলমান সেবনরত ওষুধগুলো দেখতে হবে, রোগী কোনটা খাবেন, কোনটা খাবেন না, বলে দিতে হবে। এতে পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে এবং সংযোজিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হারও অনেকাংশে কমবে।
এসব ক্ষেত্রে রোগী ও চিকিৎসক দুই পক্ষেরই যথেষ্ট সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। একাধিক চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাবে তাঁদের মধ্যেও মতভেদ দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে রোগীরাই ঘন ঘন চিকিৎসক পরিবর্তন করেন।
এ ক্ষেত্রে রোগীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ, আমাদের চিকিৎসকদের ভেতর ‘রেফারাল সংস্কৃতি’ এখনো ভালোভাবে গড়ে ওঠেনি। অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা হয়তো আগের চিকিৎসাপত্রের ওষুধ বাদ দিয়ে নতুন ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ খান। এতে হয়তো তাঁর খুব জরুরি উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ বা চর্বি কমানোর ওষুধ বাদ পড়ে যেতে পারে। অতএব পলি ফার্মেসি আমাদের দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যা ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে, জটিল রোগীদের বৃহত্তর স্বার্থে তা নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। কোন ওষুধ কত দিন খাবেন, সেটাও অনেক প্রেসক্রিপশনে লেখা থাকে না।
অনেক ক্ষেত্রেই রোগী মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ওষুধ খেতেই থাকেন। কাজেই রোগীদের ব্যবস্থাপত্র লেখার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদেরই বেশি সচেতন হতে হবে। চলমান প্রেসক্রিপশনগুলো রিভিউ করে ওষুধগুলো রেশনালাইজ করতে হবে, বিশেষ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট স্পেশালিটিতে রোগীকে রেফার করতে হবে। এভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রোগীরা রক্ষা পেতে পারেন।
ওষুধ গ্রহণের ক্ষেত্রে রোগীদের এবং তাঁদের নিকটজনদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে। কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ামাত্র তাৎক্ষণিকভাবে ওষুধ বন্ধ করে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যাঁরা আগে থেকেই নিয়মিত ওষুধ খান, যেমন−হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের; তাদের নতুন কোনো উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীই ওষুধ খেতে হবে; সরাসরি দোকান থেকে কিনে নয়।
সূত্রঃ প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০০৮
Leave a Reply