পৃথিবীর ৫ থেকে ১৫ শতাংশ নারী অতিরিক্ত অবাঞ্ছিত লোম বা হারসিউটিজমের সমস্যায় ভোগেন। এটি আসলে শুধু লোমজনিত সমস্যা নয়, এটি অনেক সমস্যা মেলানো একটি লক্ষণের অংশ।
অ্যান্ড্রোজেন নামের হরমোনজনিত শারীরিক সমস্যার একটি লক্ষণ এই অবাঞ্ছিত লোম। অ্যান্ড্রোজেনের (যেমন টেস্টোস্টেরন) মূল কাজ পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিকশিত করা। নারীর শরীরেও এ ধরনের পুরুষ হরমোন সামান্য পরিমাণে স্বাভাবিকভাবেই থাকে। কিন্তু স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি অ্যান্ড্রোজেন তৈরি হলে তাঁদের শরীরে লোমের আধিক্য দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে লোমগুলো মোটা ও গাঢ় কালো রঙের, যা মুখ, বুক, তলপেট, পিঠ, ওপরের বাহু বা ঊরুতে
দেখা যায়।
মূলত কিশোরী, তরুণী বা কম বয়সীদের সমস্যা হলেও যেকোনো বয়সেই এ ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। মেনোপজের পর অনেকেই এ সমস্যায় নতুন করে পড়তে পারেন।
হারসিউটিজমের কারণ
অবাঞ্ছিত লোমের এই সমস্যার পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস) অন্যতম। এ ছাড়া অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির রোগ, ওভারি বা ডিম্বাশয়ের টিউমার এবং অন্যান্য কিছু হরমোন গ্রন্থির অস্বাভাবিকতার উপসর্গ হিসেবে অতিরিক্ত লোমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু ওষুধের (যেমন অ্যান্ড্রোজেন বা স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ, ফিনাইটয়েন, মিনক্সিডিল) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও এ ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনো কারণই খুঁজে পাওয়া যায় না।
অতিরিক্ত লোমের প্রধানতম কারণ পিসিওএস। এ রোগে আক্রান্ত নারীদের ডিম্বাশয় থেকে অতিরিক্ত অ্যান্ড্রোজেন নিঃসরিত হয় এবং অ্যান্ড্রোজেনের প্রতি সংবেদনশীলতা বেড়ে যায়। শহুরে বিলাসী জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং কায়িক পরিশ্রমের অভাবের কারণে স্থূলতা বাড়ে। এই পিসিওএসের ব্যাপকতা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বেড়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হয়, ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীদের কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশ এ রোগে ভুগছেন।
অবাঞ্ছিত লোম কেবল সৌন্দর্যগত সমস্যা নয়, এর সঙ্গে আরও নানা সমস্যা ও জটিলতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
অনিয়মিত মাসিক
দীর্ঘদিন মাসিক বন্ধ থাকা, নির্ধারিত সময়ে আগে বা পরে অনিয়মিতভাবে মাসিক হওয়া এ রোগের অন্যতম লক্ষণ। পিসিওএসের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাসিক অনিয়মিত হলেও কারও কারও মাসিক স্বাভাবিক থাকতে পারে।
বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভপাত
এ রোগে ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণু পরিপক্ব হতে পারে না। ফলে ডিম্বস্ফুটন (ওভল্যুশন) ঠিকমতো হয় না। এ কারণে পরবর্তী সময়ে বন্ধ্যাত্ব হতে পারে। তা ছাড়া এ রোগে আক্রান্ত নারীদের গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেক বেশি।
জরায়ু ক্যানসার
দীর্ঘদিন মাসিক বন্ধ থাকলে জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।
স্থূলতা
পিসিওএসের বেশির ভাগ রোগীর ওজন বেশি, তাই এদের স্থূলতাজনিত বিভিন্ন জটিলতা থাকে। আবার কারও কারও ওজন স্বাভাবিক থাকতে পারে।
ডায়াবেটিস
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মতো পিসিওএসের মূল কারণ হলো শরীরের ইনসুলিন অসংবেদনশীলতা। ফলে পিসিওএসের রোগীর ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিস থাকে। তা ছাড়া এদের গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও অনেক বেশি।
উচ্চ রক্তচাপ
এদের অনেকের রক্তচাপ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে, রক্তে খারাপ চর্বির মাত্রাও এদের বেশি।
এসব কারণে পিসিওএসের রোগীদের হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি দীর্ঘমেয়াদে অন্যদের তুলনায় বেশি।
অতিরিক্ত ওজনের জন্য কারও স্লিপ অ্যাপনিয়া (ঘুমের সমস্যাজনিত রোগ) হতে পারে। দুশ্চিন্তা, অবসাদ, সাইকোসেক্সুয়াল সমস্যাসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যা হতে পারে। সব রোগীর একই ধরনের সমস্যা থাকে কি? না, তা নয়। পিসিওএসের সব রোগীর সব সমস্যা একসঙ্গে না–ও থাকতে পারে। সচরাচর বয়ঃসন্ধিকালে অনিয়মিত মাসিকের সঙ্গে ওজন বৃদ্ধি, ব্রন, মুখে অবাঞ্ছিত লোম ইত্যাদি উপসর্গের মাধ্যমে এ রোগের শুরু। এ সময় ওজন কমানোসহ সঠিক চিকিৎসা না করলে পরবর্তী সময়ে সন্তান ধারণে সমস্যা হতে পারে। বয়স বাড়তে থাকলে ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
কী করবেন
মনে রাখবেন, অবাঞ্ছিত লোম সমস্যার সঙ্গে অন্য আরও অনেক সমস্যা জড়িয়ে থাকতে পারে। তাই কেবল লোমের সুরাহা করতে ব্যস্ত না থেকে একজন হরমোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হন। থাইরয়েড ও অ্যান্ড্রোজেন হরমোন, রক্তে চিনি, চর্বি, রক্তচাপ, ওভারি বা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির আলট্রাসনোগ্রাম ইত্যাদি পরীক্ষার দরকার হতে পারে।
- রোগ নির্ণয়ের পর উপসর্গ অনুযায়ী পুষ্টিবিদ, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, ত্বক বিশেষজ্ঞ প্রয়োজনে মনোবিদের পরামর্শ নিতে হতে পারে।
- এ রোগের চিকিৎসা শুরু হবে জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে। সুষম খাবার, ব্যায়াম, সঠিক ওজন অর্জন করা এবং ধরে রাখা চিকিৎসার মূল ভিত্তি। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কমাতে মেটাফরমিন, মাসিকের সমস্যা, লোম এবং ব্রনের জন্য ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন-সমৃদ্ধ পিল (জন্মবিরতিকরণ বড়ি) এবং স্পাইরনোল্যাক্টোন–জাতীয় ওষুধ ব্যবহৃত হয়। ভিটামিন ডি ব্যবহারেও সুফল পাওয়া যায়। এর সঙ্গে লোম কমানোর জন্য অন্যান্য চিকিৎসা, যেমন লেজার থেরাপি, মলম ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চর্বির অস্বাভাবিকতা থাকলে তার চিকিৎসা করতে হবে। সময়মতো বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা করা হলে সে ক্ষেত্রেও সুফল পাওয়া যায়।
ডা. এ বি এম কামরুল হাসান
সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
প্রকাশ: ৭ জানুয়ারি ২০২১
Mahfuz
বিভিন্ন স্বাস্থ্য টিপস পেতে এই ওয়েবসাইট এ প্রবেশ করুন। প্রবেশ এই লেখার উপর ক্লিক করুন করতে