বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা হয় না এবং এর গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে ব্যক্তি বুঝতে পারেন না। ফলে মানসিক অবজ্ঞা ও মানসিক নির্যাতনকে চিকিৎসার আওতায় আনা হয় না খুব একটা, যদি না এটা শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের সঙ্গে সংযুক্ত কোনো ঘটনা হয়ে থাকে। এ ছাড়া কখনো কোনো গুরুতর অভিযোজনের সমস্যা (অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রবলেম), মনোসামাজিক সমস্যা, আবেগীয় সম্পৃক্ততার সমস্যা অথবা গুরুত্বপূর্ণ বিকাশজনিত কোনো সমস্যা (যেমন পেশিসঞ্চালনজনিত সমস্যা, বুদ্ধিমত্তা এবং ভাষার দক্ষতায় কোনো সমস্যা) দেখা দিলে তখন হয়তো চিকিৎসার আওতায় আনা হয়ে থাকে।
চিকিৎসার পূর্বে সমস্যাগুলোর পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করা খুবই জরুরি। কারণ মানসিক নির্যাতনের সমস্যা প্রতিকারের জন্য সঠিকভাবে চিকিৎসার পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ‘মাল্টি সিস্টেমেটিক ইন্টারভেনশন প্যাকেজ’ প্রয়োজন, যেখানে বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট ও সোশ্যাল ওয়ার্কার) একত্রে কাজ করতে পারে।
ফ্যামিলি থেরাপি, ইন্ডিভিজ্যুয়াল সাইকোথেরাপি এবং বিশেষ প্রয়োজনে ওষুধের মাধ্যমে প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ফ্যামিলি থেরাপি। বিশেষ করে মা–বাবা ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুর সঙ্গে।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট এ ধরনের সাইকোথেরাপি দিয়ে থাকেন।
—ফ্যামিলি থেরাপির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মা–বাবা ও সন্তানের সঙ্গে নেতিবাচক পারস্পরিক সম্পর্কের চক্রকে প্রতিরোধ করা এবং ইতিবাচক সম্পর্কের বিকাশ ঘটানো। সন্তানের আচরণের সঙ্গে কীভাবে প্রতিক্রিয়া করবে, সে বিষয়ে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে শেখানো।
—শিশুর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। পরিবারের মানসিক নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে শিশুকে কিছুদিনের জন্য পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।
—ইতিবাচক প্রক্রিয়ায় সন্তান লালন-পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নেতিবাচক আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা।
—মা–বাবার ব্যক্তিগত মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করা এবং তাঁদের অন্যান্য মানসিক সমস্যার জন্য সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা।
—মা–বাবা ও শিশু উভয়কে অ্যাসারটিভ স্কিল ট্রেনিং দেওয়া এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় আবেগের বহিঃপ্রকাশ করতে শেখানো।
—মানসিক অবজ্ঞার শিকারগ্রস্থ শিশুদের মধ্যে উন্নতি দেখা দেয়, যদি তাদের পরিবার থেকে সরিয়ে অন্য কোনো পরিবেশে নেওয়া হয় এবং সেখানে তাদের শারীরিক ও মানসিক চাহিদাগুলো পূরণ করা হয়।
—শিশুর শারীরিক ও মানসিক অবস্থার প্রয়োজন অনুসারে সাইকিয়াট্রিস্টের সহযোগিতা নেওয়া।
—প্রয়োজনে আইনের সহযোগিতায় নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা (আইন ও সালিশ কেন্দ্র, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহিলা, শিশু ও কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র ইত্যাদির সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে)।
তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে যে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ সব সময়ই অধিক ফলপ্রসূ। সুতরাং প্রতিরোধের জন্য কিছু বিষয় পালন করা জরুরি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য, বিশেষ করে মা–বাবার।
—শিশু জন্মের পূর্বে মা–বাবাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া এবং শিশু লালন-পালনের জন্য পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণ করা।
—শিশুর বিকাশজনিত ধাপগুলো সম্পর্কে জানা। বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে শিশুর শারীরিক ও মানসিক চাহিদাগুলো সম্পর্কে জানা এবং প্রয়োজন অনুসারে চাহিদাগুলোর সঙ্গে সঠিকভাবে প্রতিক্রিয়া করা ও চাহিদাগুলো মেটানো।
—শিশুদের প্রতি আবেগীয় অনুভূতি প্রকাশ করা। যেমন জড়িয়ে ধরা, মৌখিকভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করা, তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া, নিজের যত্ন নিতে শেখানো, শিশুদের তাদের সঠিক অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে শেখানো।
—শিশুদের দৈনন্দিন ছোট ছোট কাজের সঙ্গে পরিচয় করানো এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজগুলো করা।
—মা–বাবা ছাড়াও শিশুদের জন্য আরও ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ তৈরি করা। পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং আত্মীয়দের সঙ্গে শিশুদের পারস্পরিক যোগাযোগ তৈরি করা, যেন প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে আবেগীয় অনুভূতি শেয়ার করতে পারে।
মানসিক নির্যাতন এবং অবজ্ঞাকে তুলনামূলকভাবে খুবই কম শনাক্ত করা হয় শারীরিক নির্যাতন এবং যৌন নির্যাতনের তুলনায়। এর কারণ হিসেবে বলা যায় মানসিক নির্যাতনকে নির্যাতন হিসেবে গণ্য না করা এবং শিশুর বিকাশের ধাপ ও চাহিদা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব। এ ছাড়া মানসিক নির্যাতন শারীরিক নির্যাতনের মতো দৃশ্যমান নয় বলে গুরুত্বহীন হয়ে থাকে।
অনিচ্ছাকৃত অবহেলা এবং ইচ্ছাকৃত মানসিক নির্যাতন উভয়ই মারাত্মক রকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে শিশুর বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সুতরাং, সন্তানকে সুস্থভাবে গড়ে তুলতে হলে ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চাইলে তাকে ব্যক্তি হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করে, শরীরের পাশাপাশি তার মনেরও যত্ন নিতে হবে।
কানিজ ফাতেমা
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম আলো, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০
Leave a Reply