স্ট্রোক ব্রেন বা মস্তিষ্কের রোগ, হৃদ্রোগ নয়। দেশে মানব মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো স্ট্রোক। বর্তমানে স্ট্রোকজনিত মৃত্যু শুধু জাতীয় সমস্যা নয়; বিশ্বজনীন সমস্যা। স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে ১ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং প্রতি ৪ সেকেন্ডে ১ জন মৃত্যুবরণ করেন। বিশ্বজুড়ে স্ট্রোক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আট কোটির বেশি, এর মধ্যে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় অথবা পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন প্রায় পাঁচ কোটি। বাংলাদেশে স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। আর সরকারি হাসপাতালে যত রোগী মৃত্যুবরণ করেন তার ২০ শতাংশই স্ট্রোক রোগী।
মানুষকে স্ট্রোক বিষয়ে সচেতন করতে ২৯ অক্টোবর পালিত হয় বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এ উপলক্ষে প্রথম আলো আয়োজন করে এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ অনুষ্ঠান ‘স্ট্রোক প্রতিরোধ ও পরামর্শ’। অনুষ্ঠানটির প্রথম পর্বে ডা. লুবাইনা হকের সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি ২৮ অক্টোবর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ ছাড়া সম্প্রচারিত হয় এসকেএফের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে।
আলোচনার শুরুতেই অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী স্ট্রোক কী এবং এর কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, স্ট্রোক আক্রান্ত একজন ব্যক্তি নিজের, পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারের কর্মক্ষম তথা উপার্জনের ব্যক্তিটি পঙ্গুত্ব বরণ করলে পুরো পরিবারের ওপর নেমে আসে দুঃসহ যন্ত্রণা, কষ্ট। উপার্জন বন্ধ হওয়ায় সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য।
অথচ ৯০ শতাংশ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায় শুধু একটু সচেতন হলে। স্ট্রোক মূলত মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের রক্তবাহী নালির সেরিব্রাল হেমারেজই হলো স্ট্রোক। এতে রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটে গিয়ে রক্তপাতও ঘটতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বিকল হয়ে যায়। কখনো দেখা যায় কোনো কারণে ধমনি সরু হয়ে মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলেও স্ট্রোক হতে পারে।
তিনি জানান, স্ট্রোক প্রধানত দুই ধরনের। একটা রক্তক্ষরণজনিত বা হেমোরেজিক স্ট্রোক এবং আরেকটি হলো স্কিমিক স্ট্রোক, এতে রক্তক্ষরণ হয় না। মস্তিষ্কের ভেতরে দুর্বল কোনো রক্তনালি ফেটে গেলে বা ছিদ্র হয়ে গেলে তাকে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোক বলে। এ ক্ষেত্রে রক্ত মস্তিষ্কের ভেতরে বা আশপাশে ছড়িয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া চাপ সৃষ্টি করে কোনো অংশ ফুলে যেতে পারে, মস্তিষ্কের কোষ বা টিস্যুগুলো ক্ষয়ে যেতে পারে। অপর দিকে রক্তনালির ভেতর দিয়ে রক্ত পরিবহনের সময় যদি কোনো রক্ত জমাট বাঁধে তখন তাকে স্কিমিক স্ট্রোক বলে। এই কারণে রক্ত মস্তিস্কে পৌঁছায় না। এ ধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি। প্রায় শতকরা ৮৭ ভাগ স্ট্রোক এই ধরনের হয়ে থাকে।
এরপর আসে স্ট্রোকের কারণ ও লক্ষণ। অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বেশ কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ৯০ শতাংশ স্ট্রোক এড়ানো সম্ভব। হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ স্ট্রোকের প্রধান কারণ। শুধু উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ এড়ানো সম্ভব। যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় চার গুণ বেশি। পাশাপাশি ডায়াবেটিস রোগীদের স্ট্রোক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় তিন গুণ বেশি, আর আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি।
তিনি বলেন, স্ট্রোকের কিছু সুনির্দিস্ট লক্ষণ রয়েছে। যেগুলো দেখা দিলে বুঝতে হবে রোগী স্ট্রোকে আক্রান্ত। যেমন প্যারালাইসিস, পা, হাত, মুখ অথবা শরীরের ডান বা বাঁ অংশ অবশ হয়ে যাওয়া। কথা বলতে বা কথা বুঝতে সমস্যা হওয়া, বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়া, কথা জড়িয়ে আসা, এক চোখে অথবা উভয় চোখে দেখতে সমস্যা হওয়া, অথবা ঝাপসা দেখা, চলাফেরা করতে না পারা, চলাফেরায় ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রমে অসামঞ্জস্য দেখা দেওয়া, হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা দেখা দেওয়া। প্রাথমিক অবস্থায় কারও স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত, তা না হলে রোগীর মস্তিষ্কের বেশি অংশ নষ্ট হয়ে জটিল আকার ধারণ করতে পারে অথবা রোগীর দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা বা মৃত্যু ঘটতে পারে।
মস্তিষ্কের রক্তনালি বন্ধ হয়ে স্কিমিক স্ট্রোক হতে পারে অথবা রক্তনালি ফেটে গিয়েও হেমোরেজিক স্ট্রোক হতে পারে। অল্প সময়ের জন্য অজ্ঞান হওয়া, মাথা ঘোরা, চোখে ঝাপসা দেখা, কথা বলতে সমস্যা, শরীরের কোনো অংশ অবশ হয়ে যাওয়া এবং ৫ থেকে ১০ মিনিটে রোগীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসাকে মিনি স্ট্রোক বলা হয়।
অনুষ্ঠানে আলোচনার মধ্যেই দর্শকদের নানা সমস্যার সমাধান দেন অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী। তাঁর মতে, অলস জীবন যাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় কোমল পানীয় গ্রহণ, মাদক সেবনও স্ট্রোকের অন্যতম কারণ। মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা রক্তে অ্যাড্রেনালিন এবং কার্টিসল হরমোন বাড়িয়ে দেয় এবং রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা বৃদ্ধি করে। এতে স্ট্রোক করতে পারে। স্ট্রোকের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে সচেতন হলে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদ্রোগ, কিডনি রোগ, ডিমেনসিয়া, দৃষ্টিহীনতা, ক্যানসারের মতো জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
জাহিদুল হক
প্রথম আলো
২৮ অক্টোবর
Leave a Reply