- আঘাতজনিত, ক্ষয়জনিত এবং বাতজনিত কারণে হাঁটুর ব্যথা হয়।
- আঘাতজনিত ও বাতজনিত ব্যথা যেকোনো বয়সে হতে পারে। ক্ষয়জনিত ব্যথা ৪০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষদের ভেতর বেশি দেখা যায়।
- অস্টিওআরথ্রাইটিস প্রতিরোধের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।
- হাঁটুর ব্যথার জন্য ফিজিওথেরাপি খুবই উপকারী।
- প্রতিবছর বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির উদ্যোগে কিছু রোগীর ফ্রি অপারেশন করানো হয়।
আমাদের দেশে বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা খুবই প্রচলিত একটি সমস্যা। নানা কারণে এ ধরনের ব্যথা হয়ে থাকে। হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা এবং এর প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো এসকেএফ নিবেদিত স্বাস্থ্যবিষয়ক সাপ্তাহিক বিশেষ আয়োজন ‘ব্যথার সাতকাহন’–এর শেষ পর্বে।
ডা. বিলকিস ফাতেমার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে ছিলেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
আলোচনার শুরুতে জানা গেল হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথার কারণ সম্পর্কে। মূলত তিনটি কারণে ব্যথা বেশি হয়ে থাকে। আঘাতজনিত, ক্ষয়জনিত এবং বাতজনিত।
আঘাতজনিত ব্যথা খেলাধুলার ইনজুরি বা কোনো দুর্ঘটনায় লিগামেন্টের আঘাত থেকে হাঁটু বা জয়েন্টে ব্যথা হতে থাকে। আবার হাঁটুর জয়েন্টের কাছে কারটিলিস নামের যে নরম হাড় থাকে, সেখানে ক্ষয় দেখা দিলে হাঁটুর ব্যথা হয়। এটি সাধারণত বয়সজনিত কারণে বেশি হয়। একে অস্টিওআরথ্রাইটিসও বলা হয়। রিউমাটিজম আরথ্রাইটিস বা বাতের কারণেও ব্যথা হয়ে থাকে।
আঘাতজনিত ও বাতজনিত ব্যথা যেকোনো বয়সে হতে পারে। ক্ষয়জনিত ব্যথা বয়স্কদের (৪০ বছরের পর) ভেতর বেশি দেখা যায়।
এ ধরনের সমস্যায় হাঁটুতে ব্যথা থাকার পাশাপাশি হাঁটু ফোলা থাকবে, ভাঁজ করতে সমস্যা হবে, হাঁটুর তাপমাত্রা বেড়ে যাবে, হাঁটুর আকৃতির পরিবর্তন হতে পারে, হাঁটু ভাঁজ করতে গেলে শব্দ হয়। এ উপসর্গগুলো থাকলে রোগীরা বেশি করে চিকিৎসকের কাছে এসে থাকেন বলে জানান ডা. নজরুল ইসলাম। এ ব্যথা অনেকক্ষণ বসে থাকার পর উঠে দাঁড়ালে, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময়, অনেকক্ষণ হাঁটাচলার পর হতে পারে। এরপর আস্তে আস্তে এর তীব্রতা বেড়ে এমন পর্যায়ে যায় যে রোগী যখন বিশ্রাম নেয় তখনো ব্যথা হতে থাকে।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হাঁটুর ব্যথা হলে শুরুর দিকে চিকিৎসায় গুরুত্ব বেশি দিলে পরবর্তী সময়ে জটিলতা অনেক কম হবে।
আলোচনায় অস্টিওআরথ্রাইটিস সম্পর্কে বলা হয়। এটি হাঁটুর জয়েন্টে বেশি হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শরীরে ওজন যে জয়েন্ট বহন করে, তার ভেতর সবচেয়ে বেশি ভার পড়ে হাঁটুর জয়েন্টে। দুটি লং বোনের (টিবিয়া ও ফিমার) মাঝে এর অবস্থান। এ ছাড়া হিপ ও অ্যাঙ্কেল জয়েন্টেও ব্যথা হয়ে থাকে তবে সেটার হাঁটুর তুলনায় কম।’
ব্যথাসংক্রান্ত উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা প্রথমে কিছু রুটিন চেকআপ করে থাকেন। ব্লাড টেস্টের মাধ্যমে রোগীর ইউরিক অ্যাসিড, ডায়াবেটিস আছে কি না, সেটা দেখে নিতে হবে। আর অবশ্যই এক্স-রে করতে হবে।
অস্টিওআরথ্রাইটিসে অনেক রকমের জটিলতা হওয়ার আশঙ্কা আছে। যেমন: প্রচলিত ওষুধে কাজ না হওয়া, জয়েন্ট স্টিফ বা শক্ত হয়ে যাওয়া, হাঁটুতে ফ্লুইড জমে যাওয়া, হাঁটুর আকৃতির পরিবর্তন হয়ে যাওয়া অন্যতম।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, অস্টিওআরথ্রাইটিস প্রতিরোধের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যথা নিয়ে রোগী চিকিৎসকের কাছে গেলে তাঁরা যেভাবে রোগীকে ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাসের গাইডলাইন দেন, সেগুলো অবশ্যই মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি। এ গাইডলাইনের ভেতর আছে বেশি করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি–জাতীয় খাবার খাওয়া, হাঁটু কম ভাঁজ করা, সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ওঠা, হাইকমোড ব্যবহার করা, চেয়ারে বসে নামাজ পড়া।
ইনফেকশনজনিত বা টিউমারের কারণেও হাঁটুতে ব্যথা হতে পারে। ইনফেকশনের জন্য সেপটিক আরথ্রাইটিস যেকারওই হতে পারে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত ডায়াগনোসিস করে রোগীকে ব্যথার ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক, জয়েন্টে সাপোর্ট দেওয়া হয়। কখনো জয়েন্টে অ্যাসপিরিশন বা আরথোডমি নামের জয়েন্টের একটি অপারেশনও করা হয় বলে জানান বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক।
হাঁটুর জয়েন্টের এখন উন্নত মানের চিকিৎসাপদ্ধতি চালু হয়েছে। বিশেষ করে অপারেশনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এর ভেতর হাঁটুর রিপ্লেসমেন্টের মতো সার্জারি আমাদের দেশে বড় হাসপাতালগুলোয় হচ্ছে। এই অপারেশন অনেক ব্যয়বহুল। তবে ডা. নজরুল ইসলাম জানান, প্রতিবছর বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির উদ্যোগে কিছু রোগীর ফ্রি অপারেশন করানো হয়।
ব্যথার ওষুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে রোগীর অন্যান্য রোগ, যেমন কিডনির সমস্যা, অ্যাজমা বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে কি না জেনে সেই অনুযায়ী, নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। হাঁটুর জয়েন্টের ব্যথার চিকিৎসায় স্টেরয়েড ইনজেকশন অহরহ দেওয়া হয়। তবে বিশেষজ্ঞের মতে, এটি একটু জেনেবুঝে দেওয়া উচিত। কোন ক্ষেত্রে কতটুকু দেওয়া যাবে, এটি জেনে নিতে হবে। যেমন ডায়াবেটিক রোগীদের ডায়াবেটিসের মাত্রা কমিয়ে স্টেরয়েড ইনজেকশন দিতে হবে। আর এই ইনজেকশন বছরে দুটির বেশি দেওয়া যাবে না। দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ডা. নজরুল ইসলাম।
এ ছাড়া ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হাঁটুর জন্য এটি খুবই উপকারী। থেরাপি সেন্টারে গিয়ে দুই সপ্তাহের মতো ফিজিওথেরাপি দিলেই যথেষ্ট। পরবর্তী সময়ে যে ব্যায়ামগুলো শিখিয়ে দেওয়া হবে, সেগুলো বাসায় নিয়মিতভাবে করলেই হবে।
ফাহমিদা শিকদার
প্রথম আলো
২৯ নভেম্বর ২০২০
Leave a Reply