- বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশগুলোর তালিকায় ওপরের দিকেই রয়েছে আমাদের দেশের অবস্থান
- মারাত্মক বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরের মানুষ প্রতিনিয়ত অ্যাজমা (হাঁপানি), ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি রোগ (সিওপিডি), ফুসফুসের ক্যানসারসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে
- বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রাবল্য দিনে দিনে মানুষের ফুসফুসের প্রদাহ বাড়াচ্ছে
- ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফলমূল বা শাকসবজি খেলে বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানো যায়
‘চোখে দেখা যায় না, না থাকলে চলে না’, সেটা কী? সেটা বাতাস বা বায়ু। বিশুদ্ধ বায়ু পরিবেশের আত্মা। বায়ুতে সাধারণত ২১ শতাংশ অক্সিজেন, ৭৮ শতাংশ নাইট্রোজেন, দশমিক ৩১ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং নির্দিষ্ট অনুপাতে ওজোন, হাইড্রোজেন ইত্যাদি থাকে। যদি কোনো কারণে বাতাসে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে অন্যান্য গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায় কিংবা বালুকণার হার বেড়ে যায়, তবে তা দূষিত হয়ে যায়।
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশগুলোর তালিকায় ওপরের দিকেই রয়েছে আমাদের দেশের অবস্থান। বায়ুদূষণের পেছনে প্রধানত দুটি কারণ রয়েছে। এক. কলকারখানার ধোঁয়া, দুই. যানবাহনের ধোঁয়া। সার কারখানা, চিনি, কাগজ, পাট ও টেক্সটাইল কারখানা, ট্যানারি, তৈরি পোশাক কারখানা এবং রাসায়নিক ও ওষুধ প্রস্তুতকারী কারখানা থেকে প্রচুর ধোঁয়া নির্গত হয়।
বাতাসে ভাসছে বিষ। এর জন্য রাজধানীবাসীর প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার কোনো সুযোগ আসলে নেই। কারণ, নিশ্বাসের সঙ্গে বিষ ঢুকে যায়! বর্তমানে ঢাকার বাতাসে বিষই উড়ে বেড়াচ্ছে। এ বিষের উৎস হলো গাড়ি, আশপাশের শিল্পাঞ্চল, ইটভাটা ও নাগরিক বর্জ্য।
আমাদের শহরে প্রচুর পরিমাণ সিএনজিচালিত গাড়ি চলাচল করে। এসব সিএনজিচালিত যানবাহন থেকে বের হয় ক্ষতিকারক বেনজিন। এই বেনজিনের কারণে ঢাকায় ক্যানসারের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। এ ছাড়া সালফার ও সিসাযুক্ত পেট্রল, জ্বালানি তেলে ভেজাল ও ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের কারণে গাড়ির ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, অ্যালডিহাইডসহ সিসার নিঃসরণ বাতাসকে দূষিত করছে।
শুধু তা-ই নয়, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালু, সিমেন্ট ফেলে রাখা হচ্ছে রাস্তার পাশে উন্মুক্ত জায়গায়। আবার নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পরও অনেক নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ধুলাবালুর পরিমাণ বাড়ছে অনেক গুণ। বিশাল অঞ্চলজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলে দীর্ঘদিন ধরে এবং তা বিভিন্নভাবে চারদিকে ছড়িয়ে সৃষ্টি করছে প্রকট ধুলাদূষণ।
মারাত্মক বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরের মানুষ প্রতিনিয়ত অ্যাজমা (হাঁপানি), ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি রোগ (সিওপিডি), ফুসফুসের ক্যানসারসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
কীভাবে বায়ুদূষণের জন্য হাঁপানি হয়?
হাঁপানি ফুসফুসে বারবার হয়ে চলা একটি প্রদাহজনিত অবস্থা, যাতে কিছু উদ্দীপক প্রদাহ তৈরি সাময়িকভাবে শ্বাসনালি সরু করে দেয়। এর ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত যে ধুলা উড়ছে, তা হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের প্রধান কারণ। ধুলাবালু মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শ্বাসযন্ত্রে ঢুকে শ্বাসকষ্টের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। শহরে দূষিত বায়ুর কারণে এ রোগের রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ছে। ফ্রি র্যাডিক্যাল দেহকোষগুলোর ক্ষতি করে। দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢোকার পর সেখানে ফ্রি র্যাডিক্যালের সৃষ্টি হতে পারে। দেখা গেছে, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসব ফ্রি র্যাডিক্যাল।
কীভাবে সিওপিডি হয়?
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান পরিবেশদূষণ এবং মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অসংক্রামক ব্যাধি। ফুসফুসের একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ রোগ, যাতে ভুগছে এ দেশের লাখো মানুষ, তা থেকে যাচ্ছে পর্দার অন্তরালে। ইংরেজিতে রোগটির নাম সিওপিডি। বাংলা করলে দাঁড়ায় ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসরোধক রোগ। এটি ফুসফুসের এমন একটি রোগ, যার ফলে শ্বাসপ্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয় এবং রোগী শ্বাসকষ্টে ভোগেন। এটি ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ লাং ডিজিজ (সিওএলডি), ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ এয়ারওয়ে ডিজিজ (সিওএডি), ক্রনিক এয়ারফ্লো লিমিটেশন (সিএএল) ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ রেসপিরেটরি ডিজিজ (সিওআরডি) নামেও পরিচিত।
ফুসফুসের শ্বাসরোধক প্রক্রিয়াটি ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং তা মূলত হয়ে থাকে দূষিত বাতাস গ্রহণের কারণে ফুসফুসে সৃষ্ট প্রদাহের জন্য। এই প্রদাহের জন্য ফুসফুস দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
যেভাবে দুভাবে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়
এক. ফুসফুসের ছোট ছোট শ্বাসনালির ভেতরের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, স্থায়ীভাবে সংকুচিত হয় এবং সেখানে অতিরিক্ত শ্লেষ্মা তৈরি হয়ে বায়ুরোধক প্রক্রিয়াটি বাড়িয়ে দেয়।
দুই. ফুসফুসের বায়ু কুঠরির অস্বাভাবিক প্রদাহের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে এর সংকোচন-প্রসারণক্ষমতা নষ্ট হয় এবং রক্তে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যায়।
কীভাবে বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুসের ক্যানসার হয়?
বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের প্রাবল্য দিনে দিনে মানুষের ফুসফুসের প্রদাহ বাড়াচ্ছে। দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢোকার পর সেখানে ফ্রি র্যাডিক্যাল সৃষ্টি হতে পারে। দেখা গেছে, ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এসব ফ্রি র্যাডিক্যাল।
বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে ভিটামিন সি
ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ ফলমূল বা শাকসবজি খেলে বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকানো যায়। যাঁরা ফুসফুসের জটিল রোগে ভুগছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁপানি ও সিওপিডি রোগে যাঁরা ভুগছেন, তাঁদের রক্তে ভিটামিন সির মাত্রা কমে গেলে বায়ুতে দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সময় শ্বাসকষ্টে ভোগার ঝুঁকি বাড়ে।
লেবু, আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, আনারস, আমড়া, আম, আঙুর, কাঁচা মরিচ, জলপাই, বরই, কামরাঙা, টমেটো, বাঁধাকপি, কমলালেবু ইত্যাদি ভিটামিন সির গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এসবই সহজলভ্য। এ ছাড়া ভিটামিন সি আমাদের দেহে লোহা বা আয়রন শোষণে সাহায্য করে। মাছ বা মাংস, অর্থাৎ আমিষজাতীয় খাবার খাওয়ার সময় সঙ্গে লেবু খেলে দেহের লৌহ শোষণক্ষমতা বাড়ে।
ঢাকার বায়ু এতটাই দূষিত যে বাজারে প্রচলিত সাধারণ মাস্ক এই দূষণের কবল থেকে আমাদের ফুসফুসকে সুরক্ষা দিতে পারে না মোটেই। সাধারণ মাস্ক বাতাসের অতিক্ষুদ্র ‘পিএম ২.৫’ কণাকে প্রতিরোধে সক্ষম নয়। তাই প্রয়োজন বিশেষ ধরনের কিছু মাস্কের। ‘অ্যান্টি-পলিউশন মাস্ক’ নামে পরিচিত এই মাস্কগুলো ক্ষেত্রবিশেষে বাতাসে থাকা ক্ষতিকর ক্ষুদ্র কণা ও জীবাণুর ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম। ‘ফিল্টার ডিভাইস’ সংযুক্ত থাকায় এগুলো সাধারণ কাপড়ের তৈরি মাস্কের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ও সুরক্ষাদায়ক।
এন৯৯ ও এন১০০ মাস্ক
বিশেষ ধরনের এই মাস্ক দুটি ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষুদ্র কণা ঠেকাতে সক্ষম। এর প্রতিরোধক্ষমতা এতই ভালো যে দশমিক ৩ মাইক্রন আকৃতির কণা ও জীবাণু থেকে আপনাকে শতভাগ সুরক্ষা দেবে। এটির ব্যবহার আপনার ফুসফুসকে বাঁচাবে গাড়ি ও কলকারখানার ধোঁয়ার দূষণ, ধূলিকণা ও গন্ধ থেকে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আজিজুর রহমান / বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর ২০২০
Leave a Reply