অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি দুটো দিক বিবেচনায়ই রোজার রয়েছে হিতকর প্রভাব। স্বাস্থ্যবান থাকার জন্য উপবাস যে অপরিহার্য বিষয় তা ধর্ম, সংস্কৃতিচর্চা ও কথকতায় রয়েছে। মন ও শরীর দুটোর কল্যাণের জন্যই উপবাস অবশ্যকরণীয়। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরাও এ কথা এখন স্বীকার করছেন।
সংযম পালন মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করে, রুচিকে পরিশীলিত করে, ভালো কাজ করার জন্য প্রণোদনা দেয়, সুস্থ মানস ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। কষ্ট সহ্য করার শক্তি, ধৈর্যশক্তি ও সংযম-এ গুণাবলি মানুষ অর্জন করে আংশিকভাবে হলেও উপবাসচর্চায়।
দৈহিক-মানসিক নানা রোগ প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় উপবাসের ভূমিকা এখন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন। পাচকনালির রোগ, কোলাইটিস, যকৃতের রোগ, বদহজম, মেদস্থূলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি-এসব ব্যাধিতে উপবাসের ভূমিকা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানী মহলে ইতিবাচক আলোচনা যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি এর প্রয়োগও দেখা যাচ্ছে।
একজন সুইস চিকিৎসক ডা· বার্সিলাস লক্ষ করেছেন, কয়েকবার ওষুধ খাওয়ার চেয়েও প্রতিবিধান হিসেবে ক্ষুধার সুবিধা অনেক বেশি।
সাধারণভাবে বলতে গেলে উপবাস দেহের ক্ষয়ে যাওয়া কোষ ধ্বংসের কাজে সহায়তা করে, ক্ষুধা এ কাজকে পূর্ণতা দেয়। এরপর খাদ্য ও পুষ্টির মাধ্যমে নির্মিত হয় নতুন কোষকলা।
এ জন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, তারুণ্য পুনরুদ্ধারের জন্য উপবাস হলো একটি কার্যকর উপায়। তবে রোগী ও অতিবৃদ্ধ মানুষের জন্য উপবাসের ব্যাপারে শিথিলতা তো রয়েছেই।
উপবাসের থাকতে হবে নিয়মনীতি, কোনো কোনো বেলা না খেয়ে থাকা মানে উপবাস নয়। এতে স্বাস্থ্য ও স্ট্যামিনা বরং নষ্ট হয়।
শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা এ মাসে রোজা রাখে ও সংযম পালন করে। শুধু এ মাসেই নয়, জীবনাচরণে পরিমিতিবোধ আচার-আচরণে, আহারে-সব ক্ষেত্রে সব সময়ই প্রয়োজন।
রমজান মাসে রোজার স্বাস্থ্যহিতকর প্রভাব সম্পর্কে রয়েছে অনেক তথ্য। কীভাবে স্বস্তিতে সংযম পালন করা যায় এবং পবিত্র রমজানের আধ্যাত্মিক হিত লাভ করা যায়, এ জন্য রয়েছে পরামর্শ।
এ মাসে আহার, স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস থেকে খুব বেশি ভিন্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আহার হবে সহজপাচ্য ও সাধারণ। এ খাদ্য খেয়ে যেন স্বাভাবিক ওজন শরীরে বজায় থাকে, কমা ও বাড়া যেন ঘটে না। কেউ স্থূল হলে স্বাভাবিক ওজনে ফিরে আসার জন্য এ মাসের সংযম পালন সহায়ক।
দীর্ঘ সময় উপবাসের প্রেক্ষাপটে খেতে হবে এমন সব খাদ্য, যা ধীরে পরিপাক হয়। সেই সঙ্গে থাকবে আঁশসমৃদ্ধ খাবার। দ্রুত হজম হয় এমন খাদ্য কম খেলে ভালো।
ধীরে পরিপাক হয় এমন খাদ্য থাকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত, আবার দ্রুত পরিপাচ্য খাবার থাকে মাত্র তিন-চার ঘণ্টা।
ধীরে পরিপাক হয় এমন খাদ্যের মধ্যে রয়েছে শস্য ও বীজ। যেমন বার্লি, গম, জইচূর্ণ, শিম, ডাল, আটা, ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল। এগুলোকে বলে জটিল শ্বেতসার। দ্রুত দহন হয় এমন খাবারের মধ্যে রয়েছে চিনি, ময়দা (পরিশোধিত শর্করা)।
আঁশসমৃদ্ধ খাবার যেমন তুষ রয়েছে এমন খাদ্য, গম, আটা, শস্যদানা ও বীজ, শাকসবজি, মটরশুঁটি, শিম, বরবটি, ঢ্যাঁড়স, পুঁইশাক, মেথিশাক, খোসাসহ ফল, শুকনো ফল, ডুমুর, খেজুর, বাদাম।
খাদ্য হবে সুষম এবং প্রতিটি গ্রুপ থেকে খাবার আহরণ করতে হবে। যেমন ফল, সবজি, গোশত, কচি মোরগ, মাছ, রুটি, শস্য, দুধ ও দুধজাত খাবার। তেলে ভাজা খাবার স্বাস্থ্যকর নয়। এতে বদহজম হয়, বুক জ্বলে ও ওজন বাড়ে।
যেসব খাবার বাদ দিতে হবে সেগুলো হলো তেলে ভাজা খাবার ও চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি ও মিষ্টি খাবার। অতিভোজন বিশেষ করে সেহরির সময় বেশি চা পান করাও ঠিক নয়। চা পান করলে বেশি বেশি প্রস্রাব হয়। অনেক খনিজ তাই বেরিয়ে যায়, যা দিনের সময় প্রয়োজন। ধূমপান, মদপান কখনোই নয়।
খেতে হবেঃ সেহরির সময় জটিল শর্করা, যাতে খাদ্য বেশি সময় থাকে ও ক্ষুধা কম লাগে। হালিম হলো চিনি, আঁশ, শ্বেতসার, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের ভালো উৎস। বাদামে আছে প্রোটিন ও আঁশ, চর্বি কম। কলায় রয়েছে প্রচুর পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও শ্বেতসার।
পান করতে হবেঃ যথেষ্ট পানি ও ফলের রস, ইফতারের সময় থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত, যাতে যথাসময়ে শরীরে তরল ভারসাম্য বজায় থাকে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০০৮
Leave a Reply