ডা· পারভীন শাহিদা আখতার
অধ্যাপক, মেডিকেল অনকোলজি বিভাগ
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, মহাখালী, ঢাকা
বগলের লসিকাগ্রন্থি কাটা বা এক্সিলারি লিম্ফনোড ডিসেকশন
রক্তবাহী নালি (শিরা ও ধমনি) শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয় এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ফিরিয়ে নিয়ে আসে। রক্তপ্রবাহকালে রক্তনালির ওয়াল চুইয়ে যে তরল বা লিম্ফ (লসিকা) বের হয়ে আসে এবং কোষের বাইরে জমা হয়, তা আবার জালের মতো বিন্যস্ত খুব পাতলা নালি-প্রণালীর (লসিকা-প্রণালী) মাধ্যমে রক্তপ্রবাহে ফিরে আসে। এই লসিকা-প্রণালী শরীরের ছাঁকনি হয়ে কাজ করে। কোষের বর্জ্য, ব্যাকটেরিয়া ও বাইরের মেটারিয়াল ছেঁকে বের করে দেয়।
স্তন ও বাহুর লিম্ফ, লিম্ফ-প্রণালীর (লসিকা-প্রণালী) মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে বগলের নিচে এসে একত্র হয় এবং শস্যদানার মতো লিম্ফনোডে ছেঁকে বের হয়। লিম্ফনোডে বাইরের কোনো কিছু, যেমন স্তনের ক্যান্সার কোষ, আঙুলের ইনফেকশনের ব্যাকটেরিয়া বেধে যায়। পরে তা রক্তপ্রবাহে ছড়িয়ে যায়।
স্তনে যেকোনো ধরনের অপারেশনে কি লামপেকটমি কি মাসটেকটমিতে বগলের নিচের লিম্ফ গ্লান্ড কেটে বের করে আনা হয়। একে এক্সিলারি লিম্ফনোড ডিসেকশন বলে। অপারেশনে কেটে বের করা এসব বগলের নিচের লিম্ফ গ্লান্ড প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করে দেখা হয়, ক্যান্সার সব গ্লান্ডে ছড়িয়ে গেছে কি না। বগলের নিচ থেকে লিম্ফ গ্লান্ড অপারেশন, শরীরের ক্যান্সার মুক্ত হওয়ার বিষয়ে তেমন কোনো উপকারে আসে না। তবে ক্যান্সার বগলের লিম্ফনোডে ছড়িয়ে গেছে কি না, তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী চিকিৎসা কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি।
সেন্টিনেল নোড বায়োপসি
কোনো কোনো স্থানে সেন্টিনেল নোড বায়োপসি, এক্সিলারি লিম্ফনোড ডিসেকশনের বিকল্প হিসেবে প্রচলিত হয়েছে। স্তন অপারেশনের সময় একটি ব্লু ডাই বা রেডিওঅ্যাকটিভ যৌগ স্তনের ক্যান্সারপিণ্ডের চারদিকে ইনজেশন করে পুশ করা হয়। ওই স্থানের লিম্ফ (লসিকা) প্রণালী পুশ করা ডাই বগলের নিচে প্রথম লিম্ফনোডে (সেন্টিনেল নোড) বয়ে নিয়ে যায়। সেই নোডটি শনাক্ত করে তখনই অপারেশন করে বের করা হয় এবং পরীক্ষা করা হয়। যদি পরীক্ষায় কোনো ক্যান্সার কোষ না থাকে (নেগেটিভ), তাহলে সার্জন ধরে নেন অন্যান্য লিম্ফনোডও ক্যান্সারমুক্ত। অপারেশনের সুবিধা হলো, বগলের নিচের পুরো লিম্ফনোড অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। ফলে ওই স্থানের নার্ভ ও লিম্ফনালি প্রণালী ক্ষত হওয়ার ঝুঁকিও কমে যায়।
এক্সিলারি লিম্ফনোড ডিসেকশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
দুর্ঘটনাবশত অনেক সময় অনিবার্য কারণে ও অপারেশনে বগলের নিচের নার্ভ ও লসিকানালি প্রণালীতে আঘাত হতে পারে বা ক্ষত হতে পারে। ফলে দীর্ঘদিন বগলের নিচে অবশ বোধ থাকতে পারে। অপারেশন-সংলগ্ন বাহুর মাংসপেশিতে দুর্বলতা হতে পারে। কয়েক বছরের মধ্যে বগলের নিচের অবশ বোধ ধীরে ধীরে কমে আসে; কিন্তু স্বাভাবিক বোধ ফিরে নাও আসতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাহুর দুর্বলতাও সেরে যায়।
লিম্ফিডিমা
বগল ও বাহু ফুলে ওঠা শল্যচিকিৎসা ও রেডিওথেরাপির একটি ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বগলের নিচ থেকে লসিকাগ্রন্থি ও সংযোগকারী নালি প্রণালী কেটে বাদ দেওয়ায় ধীরে ধীরে বগলের নিচের লসিকা প্রণালী শুকিয়ে স্কার টিস্যু হয়ে যায় এবং লিম্ফ (লসিকা) প্রবাহের গতি কমে যায় বা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে বাহু ফুলে ওঠে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। লিম্ফিডিমা অপারেশনের পরপরই হতে পারে অথবা কয়েক বছর পরও হতে পারে। লিম্ফিডিমা কার হবে, কার হবে না, তা আগে থেকে আঁচ করা খুবই কঠিন।
(চলবে)
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ২৭, ২০০৮
Leave a Reply