জামিল সাহেবের বয়স ৫২ বছর। ইদানীং তাঁর মেজাজটা একটু খিটখিটে হয়ে উঠছে। একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকে। কদিন আগে বাবাকে হারিয়েছেন। নিজেকে তাঁর বড্ড একা একা লাগে। মাঝে মাঝেই ভাবেন, ‘যদি আগের দিনগুলো আবার ফিরে পাওয়া যেত’ কিংবা ‘অফিসের সহকর্মীদের চেয়ে কীভাবে আরও এগিয়ে থাকা যায়’ ইত্যাদি। রাতে তাঁর ঘুম আসে না। বিছানায় শুয়ে ভাবেন, এ জীবনে তাঁর কিছুই পাওয়া হলো না, কিছুই করা হলো না। স্ত্রীর সঙ্গে প্রতিদিন কথা-কাটাকাটি লেগেই আছে, ফলে অন্তরঙ্গ সময় কাটানো হয়েই ওঠে না। শরীরটাও যেন দুর্বল লাগে।
জামিল সাহেবের এই বয়সটাকে বলা যায় মধ্যবয়স। বিশ্বজুড়ে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় ৪৫ থেকে ৬০-এই সময়টুকুকে মধ্যবয়স বলা হয়। এই সময় পুরুষ ও নারী উভয়ের জীবনে একধরনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। হরমোন ও বয়সজনিত কারণে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটে, আবার পারিপার্শ্বিক কারণে মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ এলিয়ট জ্যাক ১৯৬৫ সালে প্রথম তাঁর লেখায় ‘মিডলাইফ ক্রাইসিস’-এর উল্লেখ করেন। নারী-পুরুষ উভয়ের জীবনেই এই বয়সটিতে একধরনের টানাপোড়েন শুরু হতে পারে। তবে সবার জীবনে কিন্তু এই বয়সে সংকটকাল আসে না। নারীর জীবনে একটু আগে আসে, আর পুরুষের জীবনে খানিকটা পরে। সংকটের প্রকরণও নারী-পুরুষভেদে আলাদা। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবয়সীদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভোগেন। এ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর। সম্প্রতি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব আলবার্টার এক গবেষণায় বলা হয়, মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে আলাদা কিছু নেই। তবে বেশির ভাগ গবেষণায় মিডলাইফ ক্রাইসিস বা মধ্যবয়সের সংকট তৈরি হয় বলে মত দেওয়া হয়েছে।
নারীর জীবনে এই সময়টাতে সংকটের একটা বড় অংশজুড়ে থাকে তাঁর শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন, হরমোনের তারতম্য, দেহে বয়সের চিহ্ন। কখনো বাড়তি হিসেবে যোগ হয় উৎকণ্ঠা আর বিষণ্নতা। পুরুষদের ক্ষেত্রে মধ্যবয়সের সংকটের মাত্রা খানিকটা ভিন্ন। এ সময় তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্র, সাফল্য-ব্যর্থতা, অপরের সঙ্গে তুলনা এবং যৌনজীবন নিয়ে সংকটে পড়ে যান। মনস্তত্ত্ববিদ হ্যারল্ড কোহেন তাঁর ‘দ্য মেল মিডলাইফ ক্রাইসিস’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন যে জীবন এক নিরন্তর বোঝা। আর এই বোঝা বহনের মাঝপথে এসে কেউ কেউ হাঁপিয়ে পড়েন। সেটাই মিডলাইফ ক্রাইসিস। এই সময় অনেক কাজের কথা মনে পড়ে, যা করা হয়ে ওঠেনি, অনেক অপ্রাপ্তির কথা মনে পড়ে, যা পাওয়া হয়নি। অনেক গোপনীয়তা মনকে পীড়া দেয়, অনেক সুপ্ত বাসনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মধ্যবয়সের সংকটের লক্ষণ কী কী
* সহকর্মী-বন্ধুদের চেয়ে নিজেকে ব্যর্থ ভাবা।
* হঠাৎ তীব্রভাবে কোনো কিছু পেতে চাওয়া; যেমন-বাড়ি নেই, যেভাবেই হোক বাড়ি করতে হবে; গাড়ি নেই, যেভাবেই হোক গাড়ি কিনতে হবে।
* একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করা, বিকল্প কিছু নেতিবাচক পথ বেছে নেওয়া; যেমন-নেশা করা, বিপরীত লিঙ্গের তৃতীয় কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া।
* তারুণ্য ফিরে পাওয়ার জোর তাগিদ অনুভব করা, হতাশা ব্যক্ত করা।
* নিজের জীবন ও জীবনযাত্রার গুণে-মানে সব সময় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা।
* স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন ও ভালোবাসায় ফাটল ধরা।
* সন্তানদের প্রতি অতি খবরদারি বা একেবারেই উদাসীন হয়ে যাওয়া।
* কারণে-অকারণে আশপাশের মানুষকে সন্দেহ করা।
* অতিরিক্ত কেনাকাটা করা।
* আশপাশের সবকিছুর প্রতি বিরক্ত হওয়া, একঘেয়েমি বোধ করা।
* অসামঞ্জস্যপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়া।
মিডলাইফ ক্রাইসিস বলে আদতে কিছু আছে কি নেই, সে নিয়ে যতই তর্ক থাকুক; মোদ্দাকথা হচ্ছে, এই সময়টাতে ভালো থাকতে হবে। শরীরে এবং মনে-সব দিক দিয়েই। আর মধ্যবয়সে ভালো থাকার জন্য যা যা করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তা হচ্ছে—
সবার আগে শরীরের যত্ন
মধ্যবয়সটি হচ্ছে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানাবিধ রোগ তৈরির বয়স। তাই সুষম খাদ্য গ্রহণ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে এই বয়সে নিজের শরীরটিকে রাখতে হবে নীরোগ।
মনের যত্নও জরুরি
এই বয়সে নিজেকে একা ভাবার কোনো কারণ নেই। পরিবারের পাশাপাশি বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটাতে হবে। মন ভালো রাখতে বেড়াতে যেতে হবে, গান শুনতে হবে, চলচ্চিত্র দেখতে পারেন; এমনকি অংশ নিতে পারেন সমাজসেবামূলক কোনো কাজে।
দাম্পত্য সম্পর্ককে স্বাস্থ্যকর রাখুন
হঠাৎ কোনো মোহে পড়ে বা অ্যাডভেঞ্চারের বশে কারও সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে তুলবেন না, যা আপনার দাম্পত্য সম্পর্কে ফাটল ধরায়। আবার অযথা আপনার জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনীকে সন্দেহও করবেন না। কোনো সমস্যা মনে করলে খোলামনে পরস্পর আলাপ করুন। দাম্পত্য সম্পর্ক স্বাস্থ্যকর রাখতে নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখুন। কোনো অসুবিধা বোধ করলে লজ্জা না পেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সন্তানের দিকে নজর দিন
কেবল নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই হবে না, সন্তানের দেখভালও আপনার অন্যতম দায়িত্ব। সন্তানের ক্যারিয়ার, তার সমস্যা ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট সময় দিন।
কর্মক্ষেত্রকে উজ্জ্বল রাখুন
আপনার কাজের জায়গাটিকে ভালোবাসুন। কী পেয়েছেন, তার হিসাব না করে কী অবদান রেখেছেন, তা মিলিয়ে নিন। দেখবেন, আপনার সফলতার পাল্লাই ভারী। আর যদি না পাওয়ার হিসাব করতে বসেন, সহকর্মীদের সঙ্গে নিজের তুলনা করেন, তবে হতাশায় পড়ে যাবেন।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা
আয়-ব্যয়ের হিসাব করুন। প্রয়োজনে সঞ্চয় করতে থাকুন। ভবিষ্যতের যেকোনো প্রয়োজন; যেমন-চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা, বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ে আর্থিক প্রস্তুতি নিন।
আত্মিক ও সামাজিক বিষয়ে মনোযোগী হোন
নিজের আত্মার তৃপ্তির জন্য নৈতিকভাবে জীবনযাপন করুন। নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিন।
নেতিবাচক পথ পরিহার করুন
নেশায় আসক্ত হয়ে যাওয়া, অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকুন। যদি মনে করেন এমন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছেন, তবে আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি কী ভাবলেন, সেটা না ভেবে আপনি কীভাবে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করুন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
কৈশোর বা বয়ঃসন্ধির মতো মধ্যবয়সও একটি বিশেষ সময়, যখন মানুষ নিজেকে আগের চেয়ে আলাদা করে চিনতে শেখে। এই সময়টাকে যতই সংকটের কাল বা ক্রাইসিস বলা হোক না কেন, যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে চলা যায়, তবে মধ্যবয়স থেকেই শুরু হতে পারে জীবনের নতুন টার্নিং পয়েন্ট। উজ্জ্বলতা আর উচ্ছলতায় ভরিয়ে তুলতে পারেন নিজেকে। পরিবার আর কর্মক্ষেত্রে হয়ে উঠতে পারেন সবার প্রিয় অনুসরণযোগ্য একজন। তাই মধ্যবয়সকে সংকটের বয়স বলা ঠিক নয়, জীবনকে ইতিবাচকভাবে দেখুন, মধ্যবয়সকে গড়ে তুলুন সম্ভাবনার সময় হিসেবে।
কেন এই সংকট
শারীরিক পরিবর্তন
শরীরে আগের মতো তেজস্বিতা থাকে না। হরমোনের পরিবর্তন ঘটে। পুরুষের ক্ষেত্রে কারও কারও যৌনক্ষমতা বা চাহিদা কমতে থাকে।
কর্মক্ষেত্রের চাপ
কর্মক্ষেত্রে এই বয়সে বেশির ভাগ পুরুষ তাঁর ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে অবস্থান করেন। নিজের সবচেয়ে সেরাটাই তিনি দিতে চান। কিন্তু সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতা তাঁকে কখনো হতাশ করে তোলে।
সময়েরচাপ
এই বয়সে মানুষ মনে করে তার সময় বুঝি ফুরিয়ে আসছে, যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। ফলে সে নিজের মধ্যে একধরনের চাপ অনুভব করে।
বাবা-মাকে হারানো
অনেক ক্ষেত্রেই মধ্যবয়সীদের মা-বাবা মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তাঁর মধ্যে একধরনের শূন্যতা তৈরি হয়।
সন্তানেরা দূরে চলে যায়
কখনো পড়ালেখা বা বিয়ে ইত্যাদি কারণে সন্তানেরা দূরে চলে যায়। ফলে শূন্যতা আরও বাড়ে।
দাম্পত্যসংকট
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্যসংকট হতে পারে। তৃতীয় কারও অনুপ্রবেশ দাম্পত্য সম্পর্ককে সংকটাপন্ন করে তোলে।
সূত্র – প্রথম আলো
Leave a Reply