ডা· আহমেদ হেলাল
সহকারী রেজিস্ট্রার
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা
মোজাফ্ফর সাহেব (কাল্পনিক নাম) একজন হিসাবরক্ষক। একদিন তাঁর মাথায় প্রশ্ন এল-পৃথিবীতে যে হারে মানুষ বাড়ছে, তাতে একসময় পৃথিবীর তাবৎ সম্পদ শেষ হয়ে যাবে; তখন মানুষ বাঁচবে কী করে? এই চিন্তা কেউ তাঁর মনে ঢোকায়নি, এর উদ্ভব হয়েছে নিজেরই মনে। কিছু সময় পরে তিনি বুঝতে পারলেন, এ প্রশ্নটা তাঁর কাছে নিরর্থক এবং এসব চিন্তা করে তাঁর নিজের বা পরিবারের বা কোম্পানির কোনো লাভ হবে না-তাই এসব চিন্তা করে লাভ নেই। কিন্তু দেখা গেল, কি অফিসে কি বাসায় বা গাড়িতে-সবখানে তাঁর মাথায় ওই একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তাটা তিনি মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চাইলেন। কিন্তু এ চিন্তা যেন তাঁকে ছাড়ছে না। ফলে যতক্ষণ জেগে থাকেন অন্য কোনো দিকে তিনি মন দিতে পারেন না।
মিসেস সাঈদার (কাল্পনিক নাম) সমস্যা আবার অন্য ধরনের। পারতপক্ষে তিনি ময়লা লাগার ভয়ে হাত দিয়ে টাকা-পয়সা ধরেন না। কিন্তু না-ধরেও তো থাকা যায় না। তাই একবার যদি ভুলক্রমে বা নিতান্ত বাধ্য হয়ে হাত দিয়ে টাকা ধরে ফেলেন, তা একেবারে চকচকে নতুন নোট বা ছেঁড়াফাটা ময়লা টাকা যা-ই হোক না কেন-এরপর শুরু হয় তাঁর হাত ধোয়ার পালা। একবার-দুবার নয়, কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বার তিনি সাবান-ডেটল প্রভৃতি দিয়ে বারবার হাত ধোবেনই ধোবেন। এতবার হাত ধোয়ার কোনো দরকার যে নেই, তা যে নিতান্তই বাড়াবাড়ি-এ কথা তিনি নিজেও বোঝেন। নিজেও চান না এতবার হাত ধুতে। কিন্তু ঘন ঘন হাত না ধুয়ে তিনি থাকতেই পারেন না।
মোজাফ্ফর সাহেবের ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তার নাম অবসেশন বা খুঁতখুঁতে চিন্তা; আর মিসেস সাঈদার সমস্যাটি হচ্ছে কম্পালশন বা খুঁতখুঁতে আচরণ। সোজা বাংলায় এ ধরনের সমস্যাকে বলা হয় শুচিবাই। অবসেশন হচ্ছে এক ধরনের চিন্তা, কল্পনা বা অনুভূতি, যা নিরর্থক। নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জেনে মানুষ নিজের মন থেকে সেগুলো দূর করতে চায়; কিন্তু কিছুতেই পারে না। এসব নিরর্থক চিন্তার বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে তাকে বিরক্তিকর জীবন যাপন করতে হয়। প্রয়োজনীয় কাজে মন দিতে পারে না, কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। অপরদিকে কম্পালশন হচ্ছে কিছু আচরণ, যেমন-একাধিকবার হাত ধোয়া, বারবার টাকা গোনা, কোনো কিছুকে ক্রমাগত এড়িয়ে চলা ইত্যাদি; যা নিরর্থক, অপ্রয়োজনীয় জেনেও কোনো কোনো মানুষ বারবার করেই যায়। রোগী নিজেও জানে, এ ধরনের চিন্তা ও আচরণ সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবু তা বারবার করে সে তার উৎকণ্ঠা দূর করতে চায়। কারও কারও মধ্যে শুধু অবসেশন, আবার কারও মধ্যে শুধু কম্পালশন থাকতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই ব্যক্তির মধ্যে খুঁতখুঁতে চিন্তা (অবসেশন) ও আচরণ (কম্পালশন) দুই-ই থাকে। অবসেশন-কম্পালশন সমস্যা এক ধরনের উৎকণ্ঠাজনিত রোগ (অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার)।
গবেষণায় দেখা গেছে, এক থেকে দুই শতাংশ লোক এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং এটি অনেকাংশেই তার মূল্যবোধ, বিশ্বাস আর সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়। নারী-পুরুষ উভয়ই সমান হারে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরদের মধ্যে এ সমস্যা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। যেকোনো বয়সে এ রোগ হতে পারে, তবে ২৫ বছর বয়সের আগেই সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ দেখা দেয়। এ সমস্যার সঙ্গে অপরাপর কিছু মানসিক রোগ ও ব্যক্তিত্বের সমস্যা থাকতে পারে।
অবসেশন-কম্পালশনের কারণ
এ রোগের জন্য গবেষকেরা বহুবিধ কারণকে দায়ী করেছেন। এর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হচ্ছে-
— মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক উপাদান, যাকে বলা হয় ‘নিউরোট্রান্সমিটার’, এর কোনো কোনোটির তারতম্যের জন্য এ রোগ হতে পারে। বিশেষত ‘সেরোটোনিন’ ও ‘নরএপিনেফ্রিন’-এর পরিমাণ ও গুণগত মান পরিবর্তিত হলে এ সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া ‘স্ট্রেপটোকক্কাল ব্যাকটেরিয়া’র ইনফেকশনের পর যদি বাতজ্বর হয়, তবে এই বাতজ্বরে আক্রান্তদের মধ্যে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ খুঁতখুঁতে চিন্তা ও আচরণের শিকার হতে পারে।
— মস্তিষ্কের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ-যেমন কডেট নিউক্লিয়াস, থ্যালামাস ও অর্বিটোফ্রন্টাল কর্টেক্সের সমন্বিত কার্যকারিতা কমে যাওয়া এ রোগের অন্যতম কারণ। বিপাক-প্রক্রিয়ার সমস্যা ও রক্ত চলাচলের বিঘ্ন ঘটলে এসব অংশের কার্যকারিতা কমে যায়।
— বংশানুক্রমিকভাবে জিনবাহিত হয়ে এ রোগ হতে পারে।
— বিশেষ ধরনের ব্যক্তিত্ব, যারা খুবই পারফেকশনিস্ট; তাদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা থাকতে পারে।
— সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, ব্যক্তিত্বের বিকাশের যে পর্যায়গুলো রয়েছে তার মধ্যে কোনো পর্যায়ের গঠন ঠিকমতো না হলে খুঁতখুঁতে চিন্তা ও আচরণের সমস্যা হতে পারে। মানুষের মনের অবদমিত কিছু কামনা-বাসনা যখন অবদমনের বাধাকে অতিক্রম করে সচেতন মনে বের হয়ে আসতে চায়, তখন কিছু চিন্তা ও আচরণ সেই কামনা-বাসনাকে সজ্ঞানে আসতে বাধা দেয় এবং এই বাধাদানের প্রক্রিয়া থেকেই খুঁতখুঁতে চিন্তা ও আচরণের উদ্ভব হয় বলে কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী মনে করেন।
লক্ষণ
একই ধরনের চিন্তা, অনুভূতি বা অবয়ব বারবার মনের মধ্যে আসতে থাকে। এগুলো মনের মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করে। ফলে তৈরি হয় উৎকণ্ঠা। এগুলো দৈনন্দিন সাধারণ চিন্তাভাবনা থেকে একেবারেই আলাদা, নিরর্থক আর অসামঞ্জস্যপূর্ণ চিন্তা।
আক্রান্ত ব্যক্তি এসব চিন্তা, অনুভূতি বা অবয়বকে দমন করতে চায়, এড়িয়ে চলতে চায়। আর এই দমন করতে গিয়ে একই কাজ বারবার করতে শুরু করে।
এই চিন্তা ও আচরণ মনের মধ্য থেকেই তৈরি হয়, বাইরে থেকে প্রক্ষিপ্ত নয়। রোগী নিজেও তা বুঝতে পারে। এগুলোর পেছনে অনেক সময় নষ্ট হয় এবং তা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে।
শরীর নোংরা হওয়ার ভয়, অহেতুক সন্দেহ, কোনো অমূলক শারীরিক সমস্যা নিয়ে চিন্তা, সবকিছুর মধ্যে নিখুঁত সামঞ্জস্য তৈরি করার ভাবনা, বিনা কারণে উত্তেজিত হয়ে পড়া, অস্বাভাবিক ও অতিরিক্ত যৌন চিন্তা ইত্যাদি অবসেশনের প্রধান লক্ষণ।
কম্পালশনের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে-বারবার একই জিনিস পরীক্ষা করা (দরজা বন্ধ কি না তা অনেকবার দেখা), অসংখ্যবার হাত ধোয়া, বেশি সময় গোসলে থাকা, কোনো কিছু বারবার গোনা (অনেকবার টাকা গুনে দেখে, তা ঠিক আছে কি না), একই প্রশ্ন বারবার করা, সবকিছূ নিখুঁতভাবে সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করা, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহে রাখা, অর্থাৎ পরে কাজে লাগতে পারে ভেবে নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় বস্তুটিও ফেলে না দেওয়া ইত্যাদি।
গায়ে ময়লা লাগবে-এ চিন্তায় কেউ কেউ ঘর থেকে বের হয় না, কোথাও বেড়াতে গিয়ে বাথরুম ব্যবহার করে না, গ্লাসে পানি খায় না। তারা ভাবে, সামান্য স্পর্শেই ময়লা-জীবাণু কোনো বস্তু থেকে তার শরীরে প্রবেশ করবে। চামচ পরিষ্কার করার জন্য কয়েক ঘণ্টা চামচটি এক গ্লাস পানিতে ডুবিয়ে রাখে, এমন শুচিবাইগ্রস্ত ব্যক্তিও রয়েছে। মনের মধ্যে সব সময় একটা সন্দেহ কাজ করতে পারে, যেমন- চুলা নেভানো হয়েছে কি না, দরজাটি বন্ধ করা হয়েছে কি না ইত্যাদি। এসব সন্দেহের কারণে শোয়া থেকে উঠে একবার-দুবার নয়, বারবার রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে থাকে চুলা বন্ধ কি না। আবার অনেকবার দরজার নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, ঠিকমতো সেটা লক করা আছে কি না। অনেক সময় এমন কিছু যৌন চিন্তা ও আচরণ (যেমন-অতিরিক্ত হস্তমৈথুন) বা কারও ক্ষতি করার চিন্তা (যেমন-কোনো কারণ ছাড়াই বিশেষ কাউকে খুন করার ইচ্ছা) বারবার ঘটতে থাকে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এসব অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। কেউ আবার সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজাতে গিয়ে অতিরিক্ত সময় নিয়ে ফেলে।
চিকিৎসা
অবসেশনঃ কম্পালশনের জন্য সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে। মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের তারতম্যের কারণে এ সমস্যা হয় বলে বিশেষ ওষুধের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা যায়। চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে ওষুধের প্রভাবে কিছুটা উন্নতি দেখা দিতে পারে। তবে পুরোপুরি ফল পেতে অপেক্ষা করতে হয় কমপক্ষে চার মাস। খেয়াল রাখতে হবে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শেই এ ধরনের রোগের চিকিৎসা নেওয়া; আর যেহেতু দু-এক দিনে ফল পাওয়া যাবে না, তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খাওয়া।
ওষুধের পাশাপাশি ধারণা ও আচরণ-পরিবর্তনকারী চিকিৎসা (কগনিটিভ-বিহেভিয়ার থেরাপি) এ রোগের জন্য বিশেষ কার্যকর। এ পদ্ধতির মূলনীতি হচ্ছে, ‘এক্সপোজার ও রেসপন্স প্রিভেনশন’। এক্সপোজার পদ্ধতিতে যে বিষয়টি নিয়ে তার খুঁতখুঁতে চিন্তা আছে, তাকে সে বিষয়টির মুখোমুখি করতে হবে। যেমন-কারও যদি ময়লা-আবর্জনা নিয়ে খুঁতখুঁতে চিন্তা থাকে, তবে তাকে ময়লার ঝুড়িতে হাত দেওয়ার জন্য বলতে হবে। প্রথমে এ বিষয়টি তার জন্য অসম্ভব মনে হলেও ধীরে ধীরে (সিস্টেমিক ডিসেনসিটাইজেশন) অথবা একবারে (ফ্লাডিং) কাজটি তাকে দিয়ে করাতে হবে। এভাবে একপর্যায়ে দেখা যাবে, ময়লা নিয়ে তার উৎকণ্ঠা কমে এসেছে। আর রেসপন্স প্রিভেনশন পদ্ধতিতে যে কাজটি বারবার না করলে সে শান্তি পায় না, সে কাজটি করা থেকে তাকে বিরত রাখতে হবে। যেমন-যে বারবার হাত ধোয়, তাকে হাতে ময়লা লাগিয়ে হাত না ধুয়ে বসিয়ে রাখতে হবে; আর তাকে বোঝাতে হবে যে এখন হাত ধোয়ার প্রয়োজন নেই, খাওয়ার আগে হাত ধুলেই চলবে। একপর্যায়ে হাত না ধোয়া সত্ত্বেও তার মনের উৎকণ্ঠা কমে আসবে। এ ছাড়া খুঁতখুঁতে চিন্তাটা বন্ধ করার জন্য অন্য কোনো বিকল্প চিন্তা বা আচরণের অভ্যাস করা যেতে পারে। যেমন-হাতে একটি রাবার-ব্যান্ড লাগিয়ে রাখতে হবে এবং যখনই মনে অবসেসিভ চিন্তাটা আসবে, তখনই রাবার-ব্যান্ডে টান দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে, এত হাতে মৃদু আঘাত লাগবে; মনের অবসেসিভ চিন্তাটা অন্যদিকে ধাবিত হবে, উৎকণ্ঠা কমে আসবে।
অনেক সময় এ ধরনের রোগীকে একটি ডায়েরি রাখতে বলা হয়। সেখানে দিনের শেষে সে তার সারা দিনের সব চিন্তা ও আচরণের বর্ণনা সময়সহ লিখবে। এতে সে দেখতে পাবে যে অনর্থক খুঁতখুঁতে চিন্তা ও আচরণের পেছনে সে সারা দিনে কত মূল্যবান সময় অপচয় করেছে। এ ডায়েরিতে সময়ের হিসাব দেখানোর উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, তার মনে এ ধারণা তৈরি করা যে এই নিরর্থক চিন্তা ও আচরণের পেছনে তার কর্মসময়ের এক বিরাট অংশ নষ্ট হচ্ছে।
আর দ্বিতীয়ত, চিকিৎসাধীন রোগী এ ডায়েরির মাধ্যমে বুঝতে পারবে যে চিকিৎসায় তার ফল হচ্ছে কি না। যদি দেখা যায়, শুরুতে যেটুকু সময় নিরর্থক চিন্তা ও কাজের পেছনে ব্যয় করত, চিকিৎসার ফলে সেই সময়ের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। এতে বুঝতে হবে, চিকিৎসায় ফল হচ্ছে। অবসেসিভ-কম্পালসিভ রোগের চিকিৎসা সময়সাপেক্ষ। তাই ধৈর্যহারা না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে এ রোগকে পরাজিত করা সম্ভব।
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ২০, ২০০৮
Leave a Reply