অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
প্রবাসজীবনে দেখেছি অনেক সার্জনকে সংগীত শুনে শুনে স্কালপেল চালাচ্ছেন। অনেক চিকিৎসককে দেখেছি ভালো পিয়ানোবাদক। এ দেশে অনেক চিকিৎসক সংগীতপ্রিয়। তেমনই হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ডা· ক্লডিয়াস কনরাড, যিনি স্টেমসেল বায়োলজি ও মিউজিক ফিলোসফি-দুটোতেই ডক্টরেট। যেমন সার্জারি করেন, তেমন বাজান পিয়ানো।
ডা· কনরাড বলেন, তিনি যখন সংগীত শোনেন, তখন তাঁর কাজ অনেক ভালো হয়। আর তাঁর নিজের গবেষণা ও অন্যদের গবেষণা উল্লেখ করে তিনি বললেন, সংগীত রোগীদের জন্য ও ভালো দেহ-মন শিথিল করে, রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন হার, ট্রেসহরমোন মান, ব্যথা, ব্যথার ওষুধের চাহিদা-সবই হ্রাস করে।
সংগীত নিরাময়ী, কিন্তু তা করে কীভাবে? এর যে শারীরবৃত্তিক পথ, তা অস্পষ্টঃ খোঁজ চলছে ধীরে। এর উত্তরে বলতে চেয়েছেন ডা· কনরাড, সংগীতের নিরাময়ী ও প্রশান্তিদায়ক ফলাফলের পেছনে রয়েছে গ্রোথ হরমোনের উদ্দীপনা।
সেন্ট লুই বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের একজন এনডোক্রিনোলজিস্ট ডা· জন মোর্লি গ্রোথ হরমোনের উদ্দীপনাকে সমর্থন না করেও বলেন, স্মায়ু-আন্তস্রাবী তন্ত্র-এ দুটোর সমন্বয়ে নির্দেশ দেয় দেহের প্রতিরোধব্যবস্থাকে। সংগীত এই সমন্বিত তন্ত্রকে উদ্দীপিত করে আর নিরাময়ের হয় সূচনা।
ডা· কনরাড হাইস্কুল পাস করে সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। পর্বতারোহী সেনাদলে চাকরি শেষে পড়েন মেডিসিন, সংগীতের চর্চাও চলে। মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র্যাজুয়েশন, এরপর দুটো ডক্টরেট, একটি মেডিকেল ডিগ্রি অর্জন।
মিউজিক নিয়ে গবেষণাপত্রে তাঁর বিষয় ছিলঃ কীভাবে এবং কেন মোজার্টের সংগীত ইনটেনসিভ কেয়ার রোগীদের ব্যথা উপশম করত। মোজার্টের সংগীতের মূর্ছনার মধ্যে যে বৈচিত্র্য, মাধুর্য ও শক্তি, তা-ই প্রশান্তি ও নিরাময় দেয় রোগীকে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে জার্নাল অব ব্রিটিক্যান কেয়ার মেডিসিনে ডা· কনরাড ও সহকর্মীরা একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। এতে সংগীতের প্রতি কিছু বিপর্যস্ত রোগী যে সাড়া দিয়েছিল, এর পেছনে একটি অপ্রত্যাশিত উপকরণের সন্ধান পাওয়ার কথা দেখেছেন, পিটুইটারি-গ্রন্থির গ্রোথ হরমোনের উত্থানের জন্য নিরাময় সূচিত হয়েছে। এর জন্য দেহ-মনে এল প্রশান্তি।
গবেষণা সহজ-সরলও ছিল। সার্জারি-পরবর্তী ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখা ১০ জন রোগীর কানে হেডফোন লাগানো হলো। রোগীর নিদ্রা-আকর্ষক ওষুধ প্রয়োগ তুলে নেওয়ার ঠিক এক ঘণ্টা পর পাঁচজনকে হেডফোনে মোজার্টের পিয়ানো বাদন শোনানো হলো আর পাঁচজনকে কিছুই শোনানো হলো না। যন্ত্রসংগীত শ্রবণ করেছেন এমন রোগীদের সাড়া পাওয়া গেল কয়েক রকমের, অন্যান্য গবেষণার মতোই। ডা· কনরাড লক্ষ করলেন, রক্তচাপ হ্রাস, হৃৎঘাত হার হ্রাস, বেদনার ওষুধের চাহিদা কমে যাওয়া, দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রেস হরমোন, ইপিনেফ্রিন ও ইন্টারলুকিন-৬-এদের মান ২০ শতাংশ হ্রাস পাওয়া-এসব ঘটল এ ক্ষেত্রেই। তবে বাড়তি যা তা হলো, পিটুইটারি-গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত গ্রোথ হরমোন ৫০ শতাংশের ওপর উঠে যাওয়া।
এর আগে গবেষকদের কেউ গ্রোথ হরমোন মান মেপে দেখেননি, এমন মন্তব্য কনরাডের। ডা· কনরাড এটি বিশেষভাবে লক্ষ করলেন এ জন্য যে, গত পাঁচ বছরে গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে মানসিক চাপে সাধারণত গ্রোথ হরমোন মান উঁচুতে ওঠে আর শিথিল অবস্থায় কমে। সেন্ট লুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা· মোর্লির প্রশ্নঃ ইপিনেফ্রিন ও আইএল-৬-এর মতো গ্রোথ হরমোনও হ্রাস পাবে, তা-ই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গ্রোথ হরমোন মান বেড়েছে।
প্রশ্ন হলো, গ্রোথ হরমোন মানের এই উঁচুতে ওঠা কি নিদ্রা-আকর্ষক ফলাফলকে উদ্দীপ্ত করল, নাকি এ ব্যাপারটি অন্য কোনো প্রক্রিয়ার অন্তর্গত বিষয়?
ডা· কনরাড যুক্তি উত্থাপন করে বলেন, গ্রোথ হরমোনের রয়েছে নিদ্রা-আকর্ষক প্রভাব। ২০০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি গবেষণা প্রবন্ধের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে দেখা গেছে, গ্রোথ হরমোন রিলিজিং ফ্যাক্টর যে রাসায়নিক বাহকটি গ্রোথ হরমোনকে কাজে প্রবৃত্ত করে, এর প্রভাবে ইন্টারলুকিন-৬-এর কার্যকলাপ হ্রাস পায়। এতে বোঝা যেতে পারে, গ্রোথ হরমোন নিজেও ইন্টারলুকিন-৬ ও ইপিনেফ্রিন মানকে কমিয়ে দিতে পারে।
ইন্টারলুকিন-৬ ও ইপিনেফ্রিনের প্রভাবে প্রদাহ হয়, যা পালাক্রমে ঘটায় ব্যথা-বেদনা, বাড়ে রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের হার।
স্ট্রেস নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের মধ্যে ডা· কনরাডের এ ব্যাখ্যা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এনডোক্রিনোলজিস্ট ডা· কিথ ডব্লিউ কেলি বলেন, ‘এ দুটো প্রক্রিয়া সব সময় যে একই রকম হবে তা নয়।’ তবে ডা· কেলি ও ডা· মোর্লি এবং রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা· ব্রসএস মেকওয়েন ডা· কনরাডের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত না হলেও বলেন, ডা· কনরাডের গবেষণা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় যে গ্রোথ হরমোনের এই উঁচুতে উঠে যাওয়া কোনো না কোনোভাবে প্রদাহ ও অন্যান্য স্ট্রেস প্রতিক্রিয়াকে অবদমিত করে।
ডা· মেকওয়েন বলেন, ‘এ ব্যাপারটি সত্যি কৌতূহলোদ্দীপক সম্ভাবনা এবং একে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।’ ডা· কনরাড ও অন্যরা ব্যাপারটি আরও ইনটেনসিভ কেয়ার রোগীদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে দেখতে চান। ডা· কনরাড আরও দেখতে চাইছেন সংগীতের মূর্ছনা সার্জনের পারফরমেন্সকে কীভাবে প্রভাবিত করে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, সার্জনরা তাঁদের পছন্দের সংগীত শ্রবণ করলে গণিত গণনা দ্রুত এবং আরও নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করতে পারেন। ডা· কনরাড তাঁদের পারফরমেন্স মান বৃদ্ধির পেছনে যে স্মায়ু শারীরবৃত্তিক ডিনামিনকস রয়েছে তা খুঁজে বের করতে চান। ডা· কনরাড অপারেশন থিয়েটারে যন্ত্রসংগীতের মূর্ছনা শুনে শুনে কাটাছেঁড়া করেন, এ রকম করেন আরও অনেকেও। সংগীতের ডক্টরেট ডিগ্রিধারী ডাক্তার, কনরাডের গবেষণার অন্যান্য ফলাফলের অপেক্ষায় থাকলাম।
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ২০, ২০০৮
Leave a Reply