ডা· মো· মুজিবুর রহমান মামুন
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট
নিবেদিতা শিশু হাসপাতাল, ঢাকা
লামিসার (কাল্পনিক নাম) বয়স দুই বছর। মা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাকে শিশু হাসপাতালে নিয়ে এলেন। ‘আমার সোনামণির কী হলো, এ রকম করে সারা শরীর কাঁপছে কেন, অন্য দিকে চেয়ে আছে কেন। হাত-পা ঝাঁকি দিয়ে উঠছে কেন। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে কেন।’ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আত্মীয়স্বজনের ভিড় জমে গেছে। হইচই।
চিকিৎসক ছুটে এলেন। সংক্ষেপে হিস্ট্রি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেল, লামিসার জ্বরের কারণে খিঁচুনি হয়েছে। জ্বর ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। খিঁচুনি হচ্ছে, অর্থাৎ তার জ্বর হয়ে খিঁচুনি। দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে খিঁচুনি বন্ধ করা হলো। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন শান্ত হলেন।
জ্বরথেকে খিঁচুনির কারণ
এ সময় প্রতিদিন জ্বর হয়ে খিঁচুনি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এমনিতে গরম, এর ওপর জ্বর হলে শরীর এত উত্তপ্ত হয় যে মস্তিষ্কে জ্বর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা শিশুরা হারিয়ে ফেলে। ফলে শিশুটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং খিঁচুনি শুরু হয়। আর এই খিঁচুনি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে মস্তিষ্কের ক্ষতি সাধন করে, যা থেকে পরবর্তêী সময়ে শিশুদের কিছু সমস্যা হয়ে থাকে।
জ্বরজনিত খিঁচুনির তেমন কোনো কারণ নেই, এটা সহজে ভালো হয়ে যায়। কমবয়সী শিশু, অর্থাৎ ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের হয়ে থাকে এটি। কিন্তু বেশি হয় ১৮ মাস বয়সের শিশুদের। জ্বর ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি হলে অনেকের খিঁচুনি হয়ে থাকে, আবার অনেকের জ্বর ১০২ থেকে ১০৩ হলেও খিঁচুনি হয় না। তাদের জ্বরসহনক্ষমতা বেশি। যাদের সহনক্ষমতা কম, তাদের একটুতে খিঁচুনি হয়ে থাকে। সাধারণত খিঁচুনি বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না। ১৫ মিনিটের কম সময় পর্যন্ত থাকতে পারে। পরীক্ষা করলে কিছুই পাওয়া যাবে না। মস্তিষ্কের কোনো ইনফেকশন বা মস্তিষ্কের পর্দা বা ঝিল্লির কোনো সংক্রমণ পাওয়া যাবে না। ইইজির রিপোর্ট নরমাল থাকবে। খিঁচুনি এক থেকে দুবার হতে পারে। প্রথম খিঁচুনির পর ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর পরবর্তী খিঁচুনি হতেও পারে, নাও হতে পারে। এটা জ্বরের ওপর নির্ভর করবে।
খিঁচুনির সময় কী করবেন
সোনামণির খিঁচুনি হচ্ছে, আপনি কী করবেন-তাকিয়ে দেখবেন, চিৎকার করবেন, নিজেকে আঘাত করে, চুল ছিঁড়ে কান্নাকাটি করবেন? না, এসব কিছুই করা ঠিক হবে না। এতে আপনার শিশুর কষ্ট বাড়বে।
আপনাকে যা করতে হবে
— সোনামণির নাক-মুখ পরিষ্কার করতে হবে, যেন কোনো ধরনের থুথু বা লালা না থাকে। কারণ এগুলো শ্বাসনালি বন্ধ করে দেবে এবং শিশুর শ্বাসকষ্ট হবে।
— পরনের কাপড় খুলে ফেলতে হবে, যেন শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়।
— খিঁচুনির সময় শরীরে যেন আঘাত না লাগে, তা লক্ষ রাখতে হবে।
— কাত করে শুইয়ে রাখতে হবে, যেন মুখনিঃসৃত রস ফুসফুসে না যায়।
— দাঁতের নিচে কিছু দিতে হবে, যেন জিভ কেটে না যায়।
— শরীর স্পঞ্জিং করতে হবে তাপমাত্রা কমানোর জন্য।
— যদি খেতে পারে, তাহলে প্যারাসিটামল সিরাপ দেওয়া যেতে পারে অথবা সাপোজিটরি ব্যবহার করা যেতে পারে, যা মলদ্বারে দিতে হবে। মলদ্বারে সেডিল বা ফ্রিজিয়াম সাপোজিটরি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দিতে পারেন। অনলাইনে অথবা আপনার শিশুর চিকিৎসকের মোবাইল ফোনে পরামর্শ নিতে পারেন।
— এসব করতে করতে আপনাকে নিতে হবে নিকটবর্তী ক্লিনিকে বা হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে। ইনফেকশন হয়েছে মনে হলে অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করতে হবে।
বাসায় যা করবেন
ভবিষ্যতে খিঁচুনি থেকে মুক্ত রাখতে হলে যে শিশুর একবার খিঁচুনি হয়েছে, তাকে আগামী পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত প্যারাসিটামল ও সেডিল বা ডায়াজিপাম শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করাতে হবে।
ভবিষ্যতে খিঁচুনি রোগীর কী হতে পারে
— সাধারণত খিঁচুনি হওয়ার পর পরবর্তী সময় কিছুই হয় না। ভালো ও সুস্থভাবেই
জীবন যাপন করবে।
— খুব কমসংখ্যক শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে। বৃদ্ধি কম হবে, হাবাগোবা বা বুদ্ধি কম হওয়া, কথা বলা বা চলাফেরায় পরিবর্তন হতে পারে।
বারবার খিঁচুনি হলে অবহেলার কারণে, যেমন-সময়মতো জ্বরের ওষুধ না খাওয়ানো, সেডিল ব্যবহার না করা ইত্যাদি কারণে সোনামণির ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে পারে। এ ধরনের শিশু পরবর্তী সময়ে মৃগী রোগে বা এপিলেপসিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
সুতরাং অবহেলা না করে জ্বর হলেই আপনার আদরের সন্তানটিকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে ভুলবেন না। নিয়মিত ওষুধ সেবন ও যত্ন সোনামণির জীবনকে পরিবর্তন করে দেবে। গড়ে উঠবে সুন্দর ও সুস্থ মন।
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০০৮
Leave a Reply