অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
রাত তিনটা। তখন যদি জাগরণে যায় বিভাবরী··· ঘুম যদি না আসে চোখে··· বিছানায় এপাশ-ওপাশ··· ঘুমের ওষুধ খোঁজা সারা হলো··· ১০০ থেকে ১, ১ থেকে ১০০ কয়েকবার গোনা শেষ হলো··· তবু ঘুম আসে না। সেই ছোটবেলায় মা-দিদিমায়েরা ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শোনাতেন ছোট্টমণিদের···। নিদ্রাদেবী কারও কাছে আসেন, কারও কাছ থেকে দূরে থাকেন-এই তো জীবনের গল্প। বড় হলে অনিদ্রা জীবনের সঙ্গী হয় কারও কারও। কিন্তু একে মোকাবিলা করা কঠিন। তবু আছে পরামর্শ।
অনিদ্রার কারণ যদি খুঁজি
অনেকের গড় ঘুমের কাল হয় সাত ঘণ্টা, অনেক দেশে ৬০ শতাংশ লোকই সপ্তাহে বেশ কিছু রাত ঘুম নিয়ে সমস্যায় পড়ে। সমস্যা হলোঃ অনেকেই সেখানেই রেখে দেয় ঘুমের উপদ্রবকে, খোঁজ করে দেখে না, কেন কাটে নিঘুêম রাত।
কোথায় শুরু করব
ঘুমের জন্য এই যুদ্ধ শুরু করার আগে জানতে হবে, ঘুমিয়ে পড়তে সমস্যা, নাকি ঘুমিয়ে থাকতে সমস্যা, নাকি দুটিই। যদি দেখা যায় ঘুমিয়ে পড়তে সমস্যা হচ্ছে অথবা সারা রাত নির্ঘুম কাটছে, তাহলে অনিদ্রা হচ্ছে বুঝতে হবে। দেখা গেল সহজেই ঘুম আসছে অথচ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল, নিয়মিতই তা ঘটছে, তাহলেও সমস্যা। ক্রনিক অনিদ্রা হয় ১০-১৫ শতাংশ লোকের। অনিদ্রা কখনো কখনো হয় মানসিক চাপের সময়। তখন ঘটতে পারে বিষণ্নতা, ঘুমের মধ্যে বোবায় ধরা, ঘুমের সময় হাত-পা ছোড়াছুড়ির মতো সমস্যা।
তখন ঘুম না হওয়ার জন্য যে বিরক্তি, সেদিকে নজর না দিয়ে দেখতে হবে, অনিদ্রার ধরনটা কী আর জাগ্রত জীবনে যেসব জিনিস ঘটছে, সে জন্য অনিদ্রা হচ্ছে কি না।
লিখতে পারেন দিনরাতের লিপি
বিছানার পাশে থাকতে পারে একটি ্লিপ জার্নাল। তবে এ নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। কিছু তথ্য লিখে রাখলেন কবে, কোন দিন, কখন ঘুম থেকে উঠলেন, আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে কতক্ষণ জেগে থাকতে হলো। নিজেই বুঝতে পারবেন নির্ঘুম রাতের কারণ, হয়তো সামনে পরীক্ষা, নয় তো সকালে বোর্ড মিটিং-চাপ মানুষকে নির্ঘুম রাতের দিকে নিয়ে যায়।
কীভাবে সাহায্য হবে এ রকম নোট রাখলে
ঘুমের সমস্যা কেমন হয়, তা লিখে রাখলে মনে হবে না যে একেবারেই ঘুম হয় না, নয় তো গভীর ঘুমে কাতর হই সব সময়, এ রকম ঘটনা ঘটে। বরং জানা যাবে, কেন আমি রাত তিনটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত জেগে ছিলাম, অথবা এমন হবে যে অনেক কাজ ছিল জমা, সেগুলো শেষ করতে গিয়ে অনেক রাতে ঘুমাতে হয়েছে। সত্য উপলব্ধির ফল হলো, এই সমাধান আসবে সহজে।
দিনের কাজকর্ম, শরীরটা একটু রাতের ঘুম আনতে সাহায্য করতে পারে
অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সামান্য ব্যায়াম করলে রাতে ভালো ঘুম আসে। দুপুরে খাওয়ার পর একটু হাঁটলেন, অফিসের ডেস্ক ছেড়ে সামান্য সময়ের জন্য যোগব্যায়াম, অনেক লাভ হবে।
খাবারের কথাও হোক
ঘুমে ঢলে পড়তে বা শুয়ে থাকতে বাধা দেয়, এমন কোনো খাদ্য, পানীয় গ্রহণ না করা ভালো। খুব ঝাল খাবার, বুক জ্বলবে, রাতের খাবারে না খাওয়াই ভালো। যদি দেখা যায়, দিনে-রাতে পানি পান করে রাতে চারবার প্রস্রাবের জন্য উঠতে হলো, তাহলে দুপুরের খাবারের আগে বেশির ভাগ পানি পান করাই ভালো। ঘুমকে চুরি করে যেসব পানীয়, সেগুলো হলো কড়া চা, কফি। তাই এসব পানীয় ভেবেচিন্তে পান করা উচিত। শোয়ার আগে যদি জলীয় খাবার খেতে হয়, তাহলে ওটমিলসহ দুধ, দই, ক্রাকারস বিস্কুট, সঙ্গে সয়া মাখন, আপেলের কয়েক ফালি, সামান্য পনির বেশ স্বাস্থ্যকর ঘুমের আগে।
ঘুমের জন্য তৈরি হতে হবে ঠিকমতো
ছোটবেলায় ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম মায়ের কোলে। বড় হয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বিছানা তৈরি করা, বালিশ ঠিকমতো রাখা, লেপ-কম্বল শীতের সময়, মশারি টাঙানো, চোখে জলের ঝাপটা দেওয়া, এক গ্লাস দুধ পান করা, এরপর রবীন্দ্রসংগীতের সুর শুনতে শুনতে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাওয়া···।
সময়মতো ঘুমোতে যাওয়া। বালিশে সুগন্ধি স্প্রে করলে ভালো হয় না? এরপর টেলিভিশন বন্ধ করা, কম্পিউটার থাকলে বন্ধ করা, এরপর নীরব অন্ধকার···। ঘুম···।
আবার একটা কথা বলি। ছোটবেলায় মা ঘুমানোর আগে এক গ্লাস দুধ খাওয়াতেন-খুব কাজের পানীয়, এ পানীয় ঘুম আকর্ষণ করে। কারণ দুধে আছে একটি অ্যামিনো এসিড ট্রিপটোফ্যান, যা মেলাটনিন ও সেবোটনিনকে রূপান্তর করে, আর ঘুমকে আকর্ষণ করে।
এমন একটি ঘুমঘর তৈরি করুন, যেখানে শুলে ঘুম আসে সহজে
শয্যাঘর কি কখনো স্বর্গসুখের ঘর হতে পারে? প্রত্যেক দম্পতি তো তা-ই চায়। কিন্তু দিনের কাজ, একগাদা কাগজপত্র, লণ্ডভণ্ড ঘর, জঞ্জাল, আঁটসাঁট জায়গা, শয্যাঘরে এসেও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচি না আমরা। শয্যাঘর একটু পরিচ্ছন্ন থাক, হালকা থাক, কম আসবাব থাক, একটি নরম শয্যা, ল্যাম্প, ছোট্ট আলমিরা-আর কী? দুটি বালিশ।
শয্যাঘর যেন শুধু থাকে ঘুমের জন্য আর আদর-সোহাগের জন্য-দম্পতির জন্য এমন ঘরের কথাই বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেই ঘর শান্ত নীরব গাঢ় অন্ধকার হলো, স্বস্তিকর, আরামের তোশক-বালিশ হলো, সুন্দর একটি শয্যা-আবরণী হলো, সুগন্ধি ছড়ানো থাকল, ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা হলো জানালা-শয্যাঘর থেকে টিভি সরানো হলো, তাতে কি সঙ্গীর মন খারাপ হবে? তবু যদি দিনের ব্যস্ততা রাতের অন্ধকারেও প্রবেশ করে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সূত্রঃ প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০০৮
Leave a Reply